মুজিব রহমান
শিলাময় গ্রহ মঙ্গল আয়রণ অক্সাইডের প্রভাবে লাল রঙের। এখানে আগ্নেয়গির, গিরিখাত, পর্বত, উপত্যকা, মরুভূমি ও মেরুস্থ হিমছত্রও রয়েছে। মঙ্গলের দিনরাত্রীর সময়কাল ও ঋতুচক্র পৃথিবীর মতোই। এর ক্ষুদে দুটি উপগ্রহও রয়েছে। দক্ষিণ মেরুর হিমছত্রে এবং ভূগর্ভে বিপুল পরিমাণ বরফ রয়েছে। হিমছত্রের বরফ গলে গেলেই ১১ মিটার গভীর পানিতে ডুবে যাবে মঙ্গল। পৃথিবীর নিকটতম গ্রহটি নিয়ে আমাদের কৌতুহলের শেষ নেই।ফলে দীর্ঘকাল যাবৎই মঙ্গলে অভিযান চলছে। সর্বশেষ গত ১৮ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলের বুকে অবতরণ করে পারসেভারেন্স রোভার এবং ইতোমধ্যেই বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করেছে।
পারসেভারেন্স ছবি তুলছে
রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষার পর নাসার মহাকাশযান পারসিভেয়ারেন্স সফলভাবে মঙ্গল গ্রহের বুকে নামার পর সেখান থেকে ছবি পাঠাতে
শুরু করেছে। গ্রহের বিষুব অঞ্চল, যার নাম জেযেরো, তার কাছে গভীর এক গহ্বরে এই রোবটকে নামানো হয়েছে। ছয় চাকার এই রোবটযান আগামী দু’বছর মঙ্গল গ্রহ থেকে নমুনা সংগ্রহের কাজ করবে। ধারণা করা হয় জেযেরোয় কয়েকশ কোটি বছর আগে বিশাল একটি হ্রদ ছিল। সেই হ্রদে ছিল প্রচুর পানি, এবং খুব সম্ভবত সেখানে প্রাণের অস্তিত্বও ছিল। পারসিভেয়ারেন্সের রোবটযানটি প্রথম যে দুটি ছবি পৃথিবীতে পাঠিয়েছে, সে দুটি তোলা হয়েছে দুর্বল শক্তির প্রকৌশলী ক্যামেরা দিয়ে। ক্যামেরার লেন্সে ধুলার আস্তরণের মধ্যে দিয়ে পারসিভেয়ারেন্স রোভার অর্থাৎ ওই রোবটযানের সামনে ও পেছনে সমতল ক্ষেত্র দেখা যাচ্ছে। নাসার বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, রোবটযানটি জেযেরোর ব-দ্বীপের মত চেহারার একটি অংশের দুই কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবতরণ করেছে। এই এলাকাতেই পারসিভেয়ারেন্স তার সন্ধান কাজ চালাবে।
হেলিকপ্টার ওড়ানো
পারসেভারেন্সের বুকে থাকা প্রায় দুই কেজি ওজনের হেলিকপ্টার ইনজেনুইটি গত ১৯ এপ্রিল প্রথমবারের মতো মঙ্গলের আকাশে ডানা মেলে। কম ঘনত্বের বাতাসে উড়োযানটি উড়তে পারবে কি না, তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা ছিল। তবে সে আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে মঙ্গলপৃষ্ঠের ১০ ফুট ওপর দিয়ে ৩৯ দশমিক ১ সেকেন্ড উড়ে বেড়ায় ইনজেনুইটি নামের হেলিকপ্টারটি। বয়ংক্রিয়ভাবে উড়াল দেওয়ার পর উড়োযানটি পৃথিবীতে তথ্য ও ছবিও পাঠিয়েছে। ২৭ কোটি ৮০ লাখ কিলোমিটার দূরত্ব পাড়ি দিয়ে সে তথ্য ধরা দেয় পৃথিবীর বুকে নাসার অ্যান্টেনায়। এতে ভালমতো মঙ্গলকে অনুসন্ধান করা সম্ভব হবে এবং ভবিষ্যতে মানুষও এমন হেলিকপ্টারে চড়ে সরাসরি মঙ্গল অনুসন্ধান করতে পারবে।
কার্বন ডাই-অক্সাইডকে ভেঙে অক্সিজেন উৎপাদন
মঙ্গলের পাতলা বায়ুমণ্ডলের ৯৫ শতাংশই কার্বন ডাই-অক্সাইড। বাকি ৫ শতাংশ নাইট্রোজেন ও আর্গন। এর মধ্যে আর্গন হলো নিষ্ক্রিয় গ্যাস। মঙ্গলে অক্সিজেনও আছে, তবে তা উপেক্ষণীয় মাত্রায় কম। মক্সি নামক একটি যন্ত্র গত ২০ এপ্রিল উচ্চ তাপে তড়িৎ বিশ্লেষণের মাধ্যমে কার্বন ডাই-অক্সাইডকে ভেঙে অক্সিজেনে পরিণত করেছে। যন্ত্রাংশটি ৫ গ্রামের মতো অক্সিজেন তৈরি করেছে মঙ্গলবার। এই পরিমাণ একজন মহাকাশচারীর প্রায় ১০ মিনিটের শ্বাসের জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের সমপরিমাণ। মঙ্গলে মানুষের অভিযানে অক্সিজেনের কোনো বিকল্প নেই। প্রথমত, শ্বাসপ্রশ্বাসের জন্য অক্সিজেন প্রয়োজন; দ্বিতীয়ত, মহাকাশযানের জ্বালানি হিসেবেও এই গ্যাস প্রয়োজন। মঙ্গলে চারজন নভোচারী পাঠাতে হলে মহাকাশযানে ১৫ হাজার পাউন্ডের জ্বালানি প্রয়োজন হবে। সব মিলিয়ে প্রয়োজন হবে ৫৫ হাজার পাউন্ড অক্সিজেন। এই বিপুল পরিমাণ অক্সিজেন পৃথিবী থেকে বয়ে নেওয়ার চেয়ে মঙ্গলেই তা উৎপাদন সহজতর বলে মনে করে নাসা।
প্রাণের খোঁজ কি মিলবে?
জেযেরোতে বিভিন্ন ধরনের পাথর রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে মাটিপাথর এবং কার্বোনেটস। এ ধরনের পাথরের যেকোন রকম অণুজীবের অস্তিত্ব সংরক্ষণের ক্ষমতা রয়েছে। ফলে সূদুর অতীতে এই গ্রহে যদি প্রাণের অস্তিত্ব থেকে থাকে, তাহলে এই পাথরের মধ্যে তার ইঙ্গিত মেলার আশা করছেন তারা। প্রাচীন হ্রদের যেটা তীর ছিল, সেখানে পলির মত যে সেডিমেন্ট রয়েছে- যাকে বলা হচ্ছে “বাথটাব রিং”।পৃথিবীতে যেটাকে স্ট্রোমাটোলাইট বলা হয়, এখানে তার সন্ধান চালাবে পারসিভেয়ারেন্স। স্ট্রোমাটোলাইট হল ব্যাকটেরিয়ার নিঃসরণ থেকে তৈরি জমাট বাধা পদার্থ। পৃথিবীতে প্রাণের প্রথম অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল স্ট্রোমাটোলাইটের জীবাশ্ম থেকেই। কোন কোন হ্রদে দেখা যায় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবাণুর আস্তরণ, এবং কার্বোনেটের মধ্যে রাসায়নিক যোগাযোগের ফলে এধরনের বিশাল শিলাখণ্ডের স্তর তৈরি হয়। জেযেরোতে যদি একই ধরনের কাঠামোর সন্ধান পাওয়া যায়, সেটা এই গবেষণায় আমাদের জন্য নতুন পথ খুলে দেবে। প্রাচীন হ্রদ এলাকার মাটিপাথরের মধ্যে খনন চালিয়ে এটি অতীত অণুজীবের অস্তিত্ব সন্ধানের কাজ করবে। সেটা হবে মঙ্গলের জৈব-জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী আবিষ্কার।
কবে আসবে নমুনা?
পারসিভেয়ারেন্স সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পাথরের নমুনা এখন সংগ্রহ করবে এবং ছোট ছোট টিউব বা সিলিন্ডারে ভরে সেগুলো মঙ্গলের পৃষ্ঠে রেখে আসবে। এই দশকের শেষে সেই সিলিন্ডারগুলো পৃথিবীতে নিয়ে আসার জন্য কয়েকশো’ কোটি ডলারের একটি যৌথ প্রকল্প হাতে নিয়েছে নাসা এবং ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা এসা (ইএসএ)। সেটি হবে জটিল একটি মিশন। এর জন্য পাঠানো হবে দ্বিতীয় একটি রোভার – মঙ্গলে পাঠানো হবে একটি রকেট এবং একটি বিশাল উপগ্রহ, যেগুলোর মাধ্যমে জেযেরো থেকে সংগৃহীত সব নমুনা পৃথিবীতে আনা হবে বিশ্লেষণ ও গবেষণার জন্য। তাই প্রাণের অস্তিত্ব জানার জন্য একটু অপেক্ষা করতেই হবে।
আপনার মতামত জানানঃ