জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। ৬৮ কোটি টাকার সাতটি প্রকল্পে ৩৭ কোটি টাকার অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে তারা। এসব প্রকল্পের প্রায় সব কটি রাজনৈতিক সুপারিশের ভিত্তিতে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি প্রকল্পের অনুমোদনে সাবেক একজন মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারীকে প্রকল্পের ১০ শতাংশ অর্থ অগ্রিম ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। দুটি প্রকল্পের প্রস্তাব অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান যথাযথ যাচাই না করেই অতিরিক্ত ব্যয় প্রাক্কলনসহ অনুমোদন দিয়েছে। দুটি প্রকল্পের সড়কবাতির ইউনিটপ্রতি মূল্যের পার্থক্য প্রায় এক লাখ এক হাজার টাকা। একটি প্রকল্পের মেয়াদ শেষের আগেই প্রায় অর্ধেক সড়কবাতি অকার্যকর হয়ে পড়ে।
‘বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন অর্থায়ন ও প্রকল্প বাস্তবায়নে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরেছে টিআইবি। গতকাল বৃহস্পতিবার ভার্চুয়াল এক সংবাদ সম্মেলনে এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
২০১৮ সালের জুন থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত সময়কালে গবেষণাকাজটি পরিচালিত হয়। এই গবেষণায় বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট তহবিলের (বিসিসিটিএফ) অর্থায়ন করা সাতটি প্রকল্প নির্বাচন করা হয়, যার আর্থিক মূল্য বিসিসিটিএফের প্রশমন খাতে বরাদ্দ করা তহবিলের ১১ শতাংশ।
গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সাতটি প্রকল্পের মধ্যে চারটি বনায়ন এবং তিনটি নবায়নযোগ্য জ্বালানি সংক্রান্ত প্রকল্প। প্রথম প্রকল্পে বনায়নের জন্য বরাদ্দ করা ৩.২৮ কোটি টাকার ৪০ শতাংশ তহবিল আত্মসাৎ করা হয়েছে। দ্বিতীয় প্রকল্পে প্রায় এক লাখ চারাগাছ কম লাগানোর অভিযোগসহ প্রকল্পের আওতায় কেনা যানবাহন ও অফিস সরঞ্জাম প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যালয় থেকে উধাও হয়ে যায়। তৃতীয় প্রকল্পে নিম্নমানের চারা রোপণসহ প্রকল্প কার্যক্রমের আংশিক বাস্তবায়ন ও ব্যয় দেখিয়ে বরাদ্দ করা তহবিলের অংশবিশেষ আত্মসাৎ করা হয়েছে। চতুর্থ প্রকল্পের ৫০ শতাংশ কাজ বাস্তবায়ন করে বাকি তহবিল আত্মসাৎ করা হয়েছে। পঞ্চম প্রকল্পে ২৮ শতাংশ অতিরিক্ত ব্যয় করা হয়েছে। ষষ্ঠ প্রকল্পে একরপ্রতি ১১ লাখ টাকা অতিরিক্ত দামে চার একর জমি কেনাসহ অতিরিক্ত ব্যয় করা হয়েছে। সপ্তম প্রকল্পে ৭০ শতাংশ অতিরিক্ত ব্যয় করা হয়েছে। এভাবে সাতটি প্রকল্পের ৬৮.০৮ কোটি টাকার প্রায় ৫৪.৪ শতাংশ অর্থ (৩৭.০৭ কোটি টাকা) সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতায় আঁতাতের মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে।
গবেষণার পর্যবেক্ষণ থেকে জানা যায়, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশি-বিদেশি উৎস থেকে প্রাক্কলিত প্রায় দুই লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা জোগানের পরিকল্পনার বিপরীতে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এই অর্থের মাত্র ৬ শতাংশ (প্রায় ১২ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা) তহবিল আন্তর্জাতিক উৎস থেকে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় উৎস থেকে ৬০৮ কোটি টাকা এবং আন্তর্জাতিক উৎস থেকে ১২ হাজার ৯১ কোটি টাকা অর্থায়ন করা হয়। আন্তর্জাতিক উৎস থেকে পাওয়া অর্থায়নের মাত্র ৬৭ শতাংশ অর্থ প্রশমন সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমে ব্যয় করা হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রশমন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কার্যকর সমন্বয় না থাকায় বাংলাদেশ এখনো আশানুরূপ সাফল্য অর্জনে করতে পারেনি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমরা অনেক অঙ্গীকারের কথা শুনতে পাই; কিন্তু বাস্তবে তার মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। জলবায়ু প্রশমন কার্যক্রমকে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে সুনির্দিষ্ট পথনকশা প্রস্তুত করা হয়নি। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতির মাত্র ৬ শতাংশ এ পর্যন্ত আমরা পেয়েছি। এর মধ্যে মাত্র ১৫ শতাংশ অনুদান, বাকি অর্থ ঋণ বা অন্যান্য শর্তে গ্রহণ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অর্থায়ন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এ চিত্র হতাশাব্যঞ্জক।’
গবেষণাভুক্ত সাতটি প্রকল্পের বিষয়ে তিনি আরো বলেন, ‘প্রকল্পের যথার্থতা, জনগণের চাহিদা, সুবিধা ও প্রকল্প বাস্তবায়নের উপযোগী স্থান বিবেচনায় না নিয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রকল্পগুলো গৃহীত ও বাস্তবায়িত হয়েছে। এর ফলে যেমন আর্থিক অপচয় হচ্ছে, অন্যদিকে প্রশমন কার্যক্রমের বাস্তব কোনো সুফল পাওয়া যায়নি, বরং প্রভাবশালী মহল দুর্নীতি ও প্রতারণার মাধ্যমে লাভবান হচ্ছে।’
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন কার্যক্রমকে ফলপ্রসূ করতে টিআইবি ১০ দফা সুপারিশ প্রস্তাব করেছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে—প্যারিস চুক্তিতে প্রতিশ্রুত অনুদানভিত্তিক প্রশমন অর্থায়ন নিশ্চিত করতে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ঐক্যবদ্ধ কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ; জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সবুজ জলবায়ু তহবিলসহ আন্তর্জাতিক তহবিলগুলো সমন্বয়ের মাধ্যমে কার্যকর পথনকশা প্রণয়ন; নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে অযৌক্তিক ব্যয় কমিয়ে সুলভে উৎপাদনে সরকারি প্রকল্পের মতো বেসরকারি খাতে বিনিয়োগকারীদেরও প্রণোদনা দেওয়া; বনায়ন ও বন্য প্রাণী আবাস সংরক্ষণসহ বন ব্যবস্থাপনায় অগ্রাধিকারমূলক প্রশমন অর্থায়ন নিশ্চিত করা; সব প্রকল্প এলাকায় তথ্য বোর্ড স্থাপনসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত তথ্য কর্মকর্তার উপস্থিতি নিশ্চিত করা; প্রকল্প তদারকি, নিরীক্ষা ও মূল্যায়ন প্রতিবেদন জনগণের জন্য উন্মুক্ত করা; জলবায়ু ট্রাস্ট তহবিল ব্যবহার নীতিমালা অন্যতম।
সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন টিআইবির উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন মো. রাজু আহমদ মাসুম। টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মনজুর-ই-আলমের সঞ্চালনায় গবেষকদলের আরেক সদস্য এম জাকির হোসেন খানও উপস্থিত ছিলেন।
সূত্র : কালের কণ্ঠ
আপনার মতামত জানানঃ