দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ কমাতে চলমান ‘কঠোর লকডাউনের’ মেয়াদ আরো এক সপ্তাহ বাড়ানো হয়েছে। আজ সোমবার(১৯ এপ্রিল) মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সচিবদের সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। তবে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের অনুমোদন মিললে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানো হবে। এদিকে নতুন এক গবেষণা বলছে, সামাজিক দূরত্ব না থাকলে ঘরের বাইরের চেয়ে ঘরের ভেতর করোনাভাইরাসের সংক্রমণের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
লকডাউন বাড়ল এক সপ্তাহ
সোমবার (১৯ এপ্রিল) সকাল ১১টায় মন্ত্রিপরিষদসচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের নেতৃত্বে ভার্চুয়ালি আন্তমন্ত্রণালয়ের এক বৈঠক হয়। বৈঠকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে চলমান ‘কঠোর লকডাউনের’ মেয়াদ এক সপ্তাহ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত এখন চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হবে। প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিলে প্রজ্ঞাপন জারি হবে। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের লকডাউন বাড়ানোর বিষয়টি জানানো হয়।
এদিকে চলমান লকডাউনের মেয়াদ ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ছে বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। সোমবার সন্ধ্যা নাগাদ লকডাউন বাড়ানোর প্রজ্ঞাপন হতে পারে।
প্রতিমন্ত্রী আরো বলেন, কারিগরি কমিটি গতকাল রোববার বৈঠক করে লকডাউন আরো ১ সপ্তাহ বাড়ানোর সুপারিশ করে।
আমরা আজ ভার্চুয়াল বৈঠক করেছি। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করে চলমান লকডাউন ২২ এপ্রিল থেকে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
আজই এ সিদ্ধান্তের সামারি (সারসংক্ষেপ) প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর আজই এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হতে পারে বলে জানান তিনি।
ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘আজকে যে সিদ্ধান্ত হল সে সামারি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন হলেই প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।’
কখন প্রজ্ঞাপন জারি হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষর হলেই দ্রুত সময়ে প্রজ্ঞাপন জারি হবে।
তিনি বলেন, ‘আগের সপ্তাহে লকডাউনে যে নির্দশনা ছিল এবারও তাই থাকছে। আগের মতই কঠোর লকডাউন হবে।’
এর আগে চলমান কঠোর লকডাউন আরো এক সপ্তাহ বাড়ানোর সুপারিশ করেছিল করোনা বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। রোববার (১৮ এপ্রিল) রাতে কমিটির ৩১তম অনলাইন সভায় এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা। পরে কমিটির পক্ষ থেকে সুপারিশগুলো সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি কমপক্ষে দুই সপ্তাহের জন্য পূর্ণ লকডাউন সুপারিশ করেছিল। সরকার এর মধ্যে ১৪ এপ্রিল থেকে এক সপ্তাহের লকডাউন ঘোষণা করেছে। কমিটি এতে সন্তোষ প্রকাশ করে। যদিও বৈজ্ঞানিকভাবে দুই সপ্তাহের কম লকডাউনে কার্যকর ফলাফল আশা করা যায় না। দেশের অর্থনীতি সচল রাখার স্বার্থে শিল্প-কলকারখানা খোলা রাখার বিষয়টি কমিটি উপলব্ধি করে। তবে বেসরকারি দপ্তর, ব্যাংক খোলা রাখা, ক্রমবর্ধমানভাবে ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল, ইফতার বাজারে অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত ভিড় লকডাউনের সাফল্যকে অনিশ্চিত করেছে।
সভায় স্বাস্থ্য, ফায়ার সার্ভিস ও অন্য জরুরি সেবা ছাড়া সব কিছু বন্ধ রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়। খোলা রাখা জরুরি সেবার তালিকাও প্রকাশ করার অনুরোধ করেছে কমিটি। অন্যথায় বিরূপ পরিস্থিতির আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। উদাহরণ হিসেবে চলমান লকডাউন এ চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের ডিউটির জন্য চলাচলে বাধা ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কথাও উল্লেখ করা হয়।
এ ছাড়া কাঁচাবাজার উন্মুক্ত স্থানে স্থাপনের প্রস্তাব দিয়ে আরো এক সপ্তাহের জন্য কঠোর লকডাউনের সুপারিশ করেছে কমিটি। পরবর্তী সপ্তাহ শেষ হওয়ার আগে সংক্রমণের হার বিবেচনা করে আবার সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। ধীরে ধীরে লকডাউন শেষ করার পরিকল্পনা প্রস্তুত রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়।
দেশে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ে সংক্রমণ ঠেকাতে প্রথম দফায় গত ৫ এপ্রিল থেকে এক সপ্তাহের লকডাউন শুরু হয়, যে বিধিনিষেধের ধারাবাহিকতা চলে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত।
এরপর দ্বিতীয় ধাপে ১৪ এপ্রিল থেকে সারাদেশে ‘সার্বাত্মক’ বা কঠোর লকডাউন শুরু হয়, যার মেয়াদ ২১ এপ্রিল পর্যন্ত। এই সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই সোমবার লকডাউনের মেয়াদ ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হলো।
বাইরের চেয়ে ঘরের ভেতর বেশি ঝুঁকিপূর্ণ
নতুন এক গবেষণায় সামাজিক দূরত্ব না থাকলে ঘরের বাইরের চেয়ে ঘরের ভেতর করোনাভাইরাসের সংক্রমণের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানিয়েছে। খবর এএফপি
করোনাভাইরাস শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। হাঁচি ও কাশির মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়ায়। ইউনিভার্সিটি অব কলোরাডো বোল্ডারের বিজ্ঞানী জোস লুইস জিমেনেজ বলেন, এ থেকে বোঝা যায় যে ঘরের ভেতরের চেয়ে ঘরের বাইরে বেশি নিরাপদ। এর কারণ ব্যাখ্যা করে জিমিনেজ এএফপিকে বলেন, ঘরের ভেতর করোনাভাইরাসের সংক্রমণের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, ঘরের ভেতর আবদ্ধ থাকে। সেখানে বাতাসের চলাচল কম থাকে। তবে ঘরের বাইরে কম বিপজ্জনক। কারণ, এখানে বাতাসের চলাচল বেশি থাকে।
জিমেনেজ এও বলেন, কম ঝুঁকি মানে এটা নয় যে একেবারেই ঝুঁকি নেই। তবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে যারা ঘরের বাইরে বেশি সময় কাটান, তাদের করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকি তুলনামূলক কম থাকে।
ঘরের বাইরে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে বেশ কিছু গবেষণা হয়েছে। গত অক্টোবর মাসে চীনের গবেষকেরা ইনডোর এয়ার নামের এক সাময়িকীতে ৭ হাজার ৩২৪টি করোনাভাইরাসের সংক্রমণের তথ্য তুলে ধরেন। এর মধ্যে সাংকিউ হেনান নামে একটি গ্রামে ঘরের বাইরে কেবল একজনের ক্ষেত্রে করোনা সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। তিনি ২৭ বছরের এক ব্যক্তি। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে ঘরের বাইরে করোনায় সংক্রমিত একজনের সঙ্গে সময় কাটানোর পর তিনি সংক্রমিত হয়েছিলেন।
সম্প্রতি আইরিশ টাইমসের তথ্যে জানা যায়, এ বছরের ২৪ মার্চ পর্যন্ত আয়ারল্যান্ডে ২ লাখ ৩২ হাজার ১৬৪ জন করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ২৬২ জন ঘরের বাইরে করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন। অর্থাৎ মাত্র শূন্য দশমিক ১ শতাংশ করোনায় সংক্রমিত হয়েছে।
ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের কীটবিজ্ঞানের অধ্যাপক ডোনাল্ড মিলটন বাইরে ভিড় এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছেন। বিশেষ করে যেখানে লোকেরা চিৎকার–চেঁচামেচি করে ও বাতাস আবদ্ধ থাকে। তবে সামাজিক দূরত্ব থাকলে ঘরের বাইরে সব সময় মাস্ক পরে থাকার প্রয়োজন আছে বলে তিনি মনে করেন না।
ডোনাল্ড মিল্টন বলেন, ‘যখন আমি ঘরের বাইরে জগিং করতে যাই, তখন দেখি ঘরবাড়িগুলোর মধ্যে ৩২ ফুট দূরত্ব রয়েছে। খুব কমসংখ্যক মানুষ বাইরে রয়েছে। এসব সময় আমি সঙ্গে মাস্ক রাখি। কিন্তু তা পরি না। যদি আমি কারও কাছে গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলি, তখন মাস্ক পরি। যদি বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে যাই, তখন মাস্ক পরি।’
জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আমেশ আদালজা বলেছেন, বদ্ধ ঘরে সামাজিক দূরত্ব না থাকলে মানুষকে মাস্ক পরতে হবে। বিশেষ করে যারা টিকা নেননি, তাদের মাস্ক পরা জরুরি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ