পবিত্র কোরআন শরিফ থেকে ২৬টি আয়াত অপসারণ চেয়ে সম্প্রতি আদালতে একটি রিট দায়ের করেছিলেন ভারতের উত্তরপ্রদেশের শিয়া ওয়াকফ বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ ওয়াসিম রিজভী। তার এই রিট আবেদন বাতিল করে দিয়েছেন দেশটির সুপ্রিম কোর্ট। আজ সোমবার (১২ এপ্রিল) এই আবেদনকে অযৌক্তিক উল্লেখ করেন আদালত। একইসাথে এই আবেদন করার অপরাধে সৈয়দ ওয়াসিম রিজভীকে ৫০ হাজার রূপি জরিমানাও করা হয়।
রায়ে বলা হয়, আবেদনের মধ্য দিয়ে বাদী একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অনুভূতিতে আঘাত হানার মতো কাজ করেছেন। তাই এই আবেদন বাতিল করা হলো এবং ধর্মীয় উস্কানিমূলক কাজ করার অপরাধে বাদীকে ৫০ হাজার রুপি জরিমানা করা হলো। রায়ে এই আবেদনকে ‘বাজে’ বলেও উল্লেখ করা হয়।
পবিত্র কোরআন শরিফ থেকে ২৬টি আয়াতের অপসারণ চেয়ে সম্প্রতি আদালতে এ রিট দায়ের করেছিলেন ভারতের উত্তরপ্রদেশের শিয়া ওয়াকফ বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ ওয়াসিম রিজভী।
১১ মার্চ সৈয়দ ওয়াসিম রিজভী ওই রিট করেন। এতে বলা হয়, ‘এই ২৬টি আয়াতে এমন কিছু আছে, যা মুসলিমদের ভিন্নধর্মী অবিশ্বাসীদের ওপর আঘাত করতে উৎসাহিত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, এগুলো আসল কোরআনের অংশ নয়। এগুলো পরে যুক্ত করা হয়েছে।’ এতে আরো বলা হয়, ‘কোরআনে এমন কিছু আয়াত আছে, যেগুলোতে সার্বভৌমত্ব, একতাবোধ ও দেশের অখণ্ডতা নিয়ে কথা বলা হয়েছে।’
তার যুক্তি ছিল, এই আয়াতগুলি মুসলিমদের তরুণ প্রজন্মকে শিখিয়ে বিধর্মীদের, বিশেষত মূর্তিপূজায় বিশ্বাসীদের হত্যা করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী বিধর্মীদের ওপর হামলা চালানোর ‘সাফাই’ হিসেবে এই আয়াতগুলো কাজে লাগাচ্ছে বলেও যুক্তি দেওয়া হয়েছিল।
এসব আয়াতকে অসাংবিধানিক এবং অকার্যকর হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানানোর পাশাপাশি এ বিষয়ে মতামতের জন্য একটি বিশেষজ্ঞ ধর্মীয় কমিটি গঠনের দাবি তুলেছিলেন এই শিয়া নেতা। শুধু তাই নয়, বিষয়টি নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ বা উপযুক্ত আইন প্রণয়নের মাধ্যমে নিজেদের নীতি স্পষ্ট করার জন্যও কেন্দ্রকে নির্দেশ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি।
রিজভীর এ আবেদন ভারতে মার্চ মাসে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে। এ নিয়ে বিক্ষোভ-প্রতিবাদও অনুষ্ঠিত হয়। ভারতের নিখিল ভারত শিয়া ল’ বোর্ড অভিযোগ তোলে, রিজভীর এই আবেদন সারা বিশ্বের মুসলমানদের জন্য অপমানজনক।
এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিতর্কিত ওয়াসিম রিজভীকে গেফতারের দাবি জানিয়েছিলেন ভারতের শিয়া এবং সুন্নি নেতারা। পবিত্র কুরআন আল্লাহর বাণী। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত কেউ কোনো দ্বিমত বা এর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেনি। এখন পর্যন্ত আর কোনো শিয়ার পক্ষ থেকেও কুরআন নিয়ে এ ধরনের কোনো মন্তব্য আসেনি।
ভারতের মজলিস-এ-উলেমা-এ-হিন্দ এর সাধারণ সম্পাদক মাওলানা কালবে জাওয়াদ বলেছেন, রিজভী মুসলিমবিরোধী এজেন্টের সদস্য। তাকে গ্রেপ্তার করা উচিত। তা নাহলে এটা পরিস্কার যে সরকার দাঙ্গা চাচ্ছে। রিজভী না শিয়া না মুসলিম। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
রিজভীর করা রিটের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরাও বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন।
সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবনের সামনের চত্বরে গত ১৮ মার্চ আল কোরআন স্টাডি সেন্টার আয়োজিত মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশে আইনজীবীরা বলেন, ‘পবিত্র কোরআন মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হওয়া সর্বশেষ ও শ্রেষ্ঠ আসমানি কিতাব। মানবজাতির মুক্তির একমাত্র সংবিধান। কোরআন শরিফ আল্লাহ তায়ালার কালাম। তিনি নিজেই কিয়ামত অবধি এ কোরআন সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন। মুসলমানদের আকিদা বিশ্বাস, অবতীর্ণ হওয়া থেকে শুরু করে আজকের দিন পর্যন্ত কোরআন শরিফের একটি আয়াত এমনকি একটি অক্ষরও পরিবর্তন হয়নি এবং কিয়ামত পর্যন্ত কেউ পরিবর্তন করতে পারবে না।’
এদিকে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে আজ সোমবার প্রথম দিনের শুনানিতেই তিনজন বিচারপতির বেঞ্চ আবেদনটিকে ‘পুরোপুরি ভিত্তিহীন’ বলে নাকচ করে দিয়েছেন।
বেঞ্চের নেতৃত্বে ছিলেন জাস্টিস রোহিংটন নরিম্যান, তিনি এমনও প্রশ্ন তোলেন, “আবেদনকারী কি এই পিটিশন নিয়ে সত্যিই সিরিয়াস? আমরা তো বিশ্বাসই করতে পারছি না!”
অর্থহীন বিষয় নিয়ে মামলা রুজু করে আদালতের সময় নষ্ট করার জন্য আবেদনকারীর আর্থিক জরিমানা করারও সিদ্ধান্ত নেয় শীর্ষ আদালত।
সোমবারের শুনানিতে আবেদনকারীর পক্ষে সিনিয়র আইনজীবী আর কে রাইজাদা অবশ্য যুক্তি দিয়েছিলেন, মাদ্রাসা শিক্ষাকে একটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনার সীমিত লক্ষ্য নিয়েই এই পিটিশন দাখিল করা হয়েছে।
তিনি বলেন, “আমার সাবমিশন হল এই বিশেষ আয়াতগুলো বিধর্মী বা কাফিরদের বিরুদ্ধে সহিংসতার হয়ে সওয়াল করে।”
তিনি যুক্তি দেন, “খুব অল্প বয়স থেকে যে বাচ্চাদের মাদ্রাসায় থেকে পড়াশুনো করতে হয়, তাদের এগুলো শিখিয়ে মগজধোলাই করা হয়— যা কখনওই কাম্য নয়”।
সুপ্রিম কোর্টের তিন সদস্যের বেঞ্চ অবশ্য এরপরও পরিষ্কার জানিয়ে দেয় তারা এই বিষয় নিয়ে কোনও তর্কবিতর্ক শুনতেও আগ্রহী নয়।
আবেদনকারীকে ৫০,০০০ রুপির প্রতীকি জরিমানা করে তারা আবেদনটিকে পত্রপাঠ খারিজও করে দেন।
এর আগেও ১৯৮৮ সালে কলকাতা হাইকোর্টে দুজন হিন্দু ব্যক্তি কুরআনের কিছু কিছু আয়াতকে চ্যালেঞ্জ করে রিট দায়ের করেছিলেন, এর প্রতিবাদে বাংলাদেশসহ পুরো ভারতে মুসলমানরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। পরে মামলাটি প্রত্যাহার করা হয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০১২
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ