গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্স-২০২০এ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নিচে বাংলাদেশের অবস্থান। সূচকটি তৈরিতে শিক্ষা, প্রযুক্তি, উন্নয়ন ও উদ্ভাবনসহ সাতটি বিষয়কে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচী এবং মোহাম্মদ বিন রশিদ আল-মাকতুম নলেজ ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে ১৩৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১২তম। আর টানা চতুর্থবারের মতো এই তালিকায় শীর্ষে আছে সুইজারল্যান্ড।
সাতটি সেক্টরের অধীনে ১৩৩টি চলক বিশ্লেষণ করে গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্সের তালিকাটি তৈরি করা হয়েছে। প্রধান সাতটি সেক্টর হচ্ছে: প্রাক্-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা, প্রযুক্তিগত ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ, উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা, উন্নয়ন এবং উদ্ভাবন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, অর্থনীতি এবং সাধারণ সক্ষমতার পরিবেশ।
প্রাক্-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষায় বাংলাদেশ বিশ্বে ৬৯তম, উচ্চতর শিক্ষায় ১২৯তম, গবেষণা, উন্নয়ন ও উদ্ভাবনে ৯৬তম, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিতে ৯৭তম এবং অর্থনীতিতে ১১৪তম। তালিকায় একেবারেই শেষে রয়েছে চাদ। দেশটির ওপরে থাকা চার দেশ হলো যথাক্রমে অ্যাঙ্গোলা, মৌরিতানিয়া, নাইজার ও কঙ্গো।
২০১২ সালের তুলনায় বাংলাদেশ বিভিন্ন চলকে শূন্য দশমিক ৯ পয়েন্ট উন্নীত করলে মোট ৩৫ দশমিক ৯ পয়েন্ট অর্জন করেছে। এটি বৈশ্বিক গড় পয়েন্ট ৪৬ দশমিক ৭–এর চেয়ে অনেক কম। ২০১২ সালেও গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১২তম। সূচক অনুযায়ী, মধ্যম মানের ২৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৯ নম্বর স্থানে আছে।
গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্সের সবার ওপরের দেশ সুইজারল্যান্ডের পয়েন্ট ৭৩ দশমিক ৬। তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্র, পয়েন্ট ৭১ দশমিক ১। তৃতীয় স্থানে থাকা ফিনল্যান্ডের পয়েন্ট ৭০ দশমিক ৮।
দক্ষিণ এশিয়ায় দেশগুলোর মধ্যে সবার ওপরে আছে ভারত। দেশটির স্কোর ৪৪ দশমিক ৪। তালিকায় ভারত আছে ৭৫তম অবস্থানে। এরপর ৮৭তম অবস্থানে রয়েছে শ্রীলঙ্কা, স্কোর ৪২ দশমিক ১। এ ছাড়া, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ৪০ দশমিক ৯ স্কোর নিয়ে ভুটান তৃতীয়, ৩৬ দশমিক ২ স্কোর নিয়ে নেপাল চতুর্থ ও ৩৫ দশমিক ৯ স্কোর নিয়ে পঞ্চম অবস্থানে আছে পাকিস্তান। ৩৫.৯ স্কোর নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় সবার শেষে রয়েছে বাংলাদেশ যা দেশটির শিক্ষা, প্রযুক্তি, উন্নয়ন ও উদ্ভাবনের দুর্বল অবস্থানকে নির্দেশ করে
অবাক করার মত বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের চেয়েও ৪ বছর পরে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত ভিয়েতনাম এই তালিকার ৬৬তম অবস্থানে রয়েছে
বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে ১৩৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ খুবই কম নম্বর পেয়ে একেবারে শেষের কাতারে থাকা দেশগুলোর জায়গায় স্থান পাওয়ায় শিক্ষাবিদ এবং গবেষকরা উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।
জ্ঞান সূচকে কেন এতটা পিছিয়ে বাংলাদেশ— এমন এক প্রশ্নে শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বিবিসিকে বলেন, জ্ঞানের যে অনুশীলন তার মূল্য পৃথিবীজুড়েই কমে গেছে। এখন আসছে তথ্যের যুগ। তথ্য আর জ্ঞানতো এক না।
তিনি বলেন, তথ্যের অবাধ প্র্রবাহ জ্ঞানের চর্চাকে খর্ব করছে পৃথিবী জুড়েই। জ্ঞান এখন পুরো পৃথিবীতে পণ্যে পরিণত হয়েছে, কেনা যায়। নিজের অনুশীলন বা গবেষণা দরকার হয় না। এটা কেনা যায়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরিস্থিতি আরো খারাপ।
তিনি বলেন, আমরা দেখছি যে জ্ঞানের মূল্য এখন সমাজে নেই, রাষ্ট্রে নেই, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেখানে জ্ঞানের চর্চা থাকবে সেখানেও আমরা জ্ঞানের মূল্যটা আমরা দিতে পারছি না। প্রতিষ্ঠানের যিনি প্রধান হন, তিনি জ্ঞানানুশীলনের জন্য সেই জায়গায় যান না।
তার যোগ্যতাটা হচ্ছে তিনি দলের সাথে আছেন, রাজনৈতিক আণুকূল্য পাচ্ছেন, তদবীর করছেন …কাজেই তিনি কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন না, অনুপ্রাণিত করতে পারেন না। আবার যারা শিক্ষকতা পেশায় আছেন, এখানে উন্নতি নির্ভর করছে ওই দলীয় আনুগত্যের ওপর এবং সেজন্য গবেষণাও কমছে, প্রকাশনাও হচ্ছে না।
এ ব্যাপারে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে. চৌধুরী বলেন, “উচ্চমান অর্জনের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি বা শিক্ষকদের গবেষণা, শিক্ষার্থীদের গবেষণাগার, পাঠাগার এগুলো কিন্তু উন্নতমানের থাকতে হয়। এখানেও কিন্তু আমরা অনেক পিছিয়ে পড়েছি”।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার পেছনে রাষ্ট্র ও সমাজে জ্ঞানীদের মূল্যায়ন না থাকার পাশাপাশি জ্ঞান চর্চার অনেক মৌলিক সমস্যারও সমাধান হয়নি।
শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, জ্ঞানচর্চার পরিবেশও বাংলাদেশে স্বাধীন নয়। জ্ঞানের যে অনুশীলন সেটার সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা হলো মাতৃভাষার মাধ্যমে। মাতৃভাষার মাধ্যমে জ্ঞানের চর্চা না করলে সেই চর্চা গভীর হয় না, স্থায়ী হয় না, প্রভাবশালী হয় না। সেটা আমরা করতে পারি নাই।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা অনুবাদ করতে পারিনি পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞানের বই। আমরা নিজেদের ভাষায় পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞানকে নিয়ে এসে সেই গ্রন্থ রচনা করতে পারিনি। আমরা সেটা সকলের কাছে পৌঁছে দিতে পারিনি। কাজেই জ্ঞান কিন্তু একজন দু’জনের ওপর নির্ভর করে না। জ্ঞান নির্ভর করে গোটা সমাজের ওপর। সমাজের যে কাঠামো আছে সেই কাঠামোর ওপর”।
বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে তালিকাভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে কাছাকাছি সময়ে স্বাধীন কোরিয়া এবং ভিয়েতনামে রয়েছে দীর্ঘ যুদ্ধের ইতিহাস। এসব দেশের অগ্রগতির পেছনেও একটা বড় কারণ হলো শিক্ষা এবং গবেষণায় বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ। বাংলাদেশে শিক্ষায় বিনিয়োগ এখনো কাঙ্খিত নয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪১৩
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ