বিশ্ব মানচিত্রে থাকা দেশগুলো থেকে বিভিন্ন সূচকে অগ্রগতি অর্জন করলেও উদ্ভাবনশীলতা সূচকে আশানুরূপ সাফল্য অর্জন করতে পারেনি বাংলাদেশ। চলতি বছরের বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকের (গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্সের) তালিকা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ও মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম নলেজ ফাউন্ডেশন (এমবিআরএফ)। এ তালিকায় বিশ্বের ১৫৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২০তম। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নিচে বাংলাদেশ। আর টানা চতুর্থবারের মতো এই তালিকায় শীর্ষে আছে সুইজারল্যান্ড।
প্রযুক্তিগত ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ আর জ্ঞান অর্থনীতিতে সূচকে ভালো পারফরম্যান্স করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু গবেষণা, উন্নয়ন ও উদ্ভাবনে ধারাবাহিকভাবে খারাপ করে চলেছে।
বাংলাদেশের স্কোর ২ দশমিক ২ বেড়েছে এবার। ফলে সার্বিক স্কোর বেড়ে হয়েছে৩৮ দশমিক ১। তারপরও বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে কম স্কোর অর্জন করেছে বাংলাদেশ।
২০২১ সালের জ্ঞান সূচক তৈরিতে সাতটি বিষয়কে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এগুলো হলো—প্রাক্-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা, প্রযুক্তিগত ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা, গবেষণা, উন্নয়ন ও উদ্ভাবন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, অর্থনীতি এবং সাধারণ সক্ষমতার পরিবেশ।
গবেষণা, উন্নয়ন ও উদ্ভাবন খাতে বাংলাদেশের স্কোর মাত্র ১৯ দশমিক ২ এবং ১৩৬তম অবস্থানে রয়েছে।
বাংলাদেশের পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, সূচকটিতে বাংলাদেশের গবেষণা ও উন্নয়নের বাস্তব চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি বলেন, এই খাতে দুরবস্থার একটি বড় কারণ হলো, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্বের শীর্ষ ৫০০তেও নেই।
সাতটি উপসূচকের মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে ভালো স্কোর পেয়েছে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ খাতে। এ খাতে ৫১ দশমিক ৫ স্কোর নিয়ে ৭৭তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
অর্থনীতির উপসূচকে ৪৬ দশমিক ৯ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১০১তম। ৪৪ দশমিক ৭ স্কোর নিয়ে প্রাক্-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা খাতে ১১৯তম অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। এছাড়া আইসিটি খাতে ২৮ দশমিক ৩ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৭তম। সাধারণ সক্ষমতার পরিবেশে বাংলাদেশের স্কোর ৪১, অবস্থান ১৩৪তম।
বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকের তালিকায় টানা পঞ্চমবারের মতো শীর্ষস্থান দখল করেছে সুইজারল্যান্ড। তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্র, তৃতীয় স্থানে ফিনল্যান্ড এবং চতুর্থ স্থানটি নেদারল্যান্ডসের দখলে।
গত বছর ৩৫ দশমিক ৯ স্কোর নিয়ে বিশ্বের ১৩৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১১২তম অবস্থানে ছিল। গতবারও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নিচে ছিল বাংলাদেশ।
এ বছর ৩৮ দশমিক ১ স্কোর নিয়ে পাকিস্তান (১২৩তম) ও নেপালকে (১২৮তম) পিছনে ফেলেছে বাংলাদেশ।
তথ্যের অবাধ প্র্রবাহ জ্ঞানের চর্চাকে খর্ব করছে পৃথিবী জুড়েই। জ্ঞান এখন পুরো পৃথিবীতে পণ্যে পরিণত হয়েছে, কেনা যায়। নিজের অনুশীলন বা গবেষণা দরকার হয় না। এটা কেনা যায়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরিস্থিতি আরো খারাপ।
৪৬ দশমিক ৬ স্কোর নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে আছে শ্রীলঙ্কা। দেশটির বৈশ্বিক অবস্থান ৮৬তম। ৯৭তম অবস্থানে থেকে এই অঞ্চলে দ্বিতীয় শীর্ষস্থানে আছে ভারতে।
দক্ষিণ এশিয়ায় ভুটান ও বাংলাদেশ যথাক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থ স্থান দখল করেছে।
জ্ঞান সূচকে কেন এতটা পিছিয়ে বাংলাদেশ—বিশ্লেষকরা বলেন, জ্ঞানের যে অনুশীলন তার মূল্য পৃথিবীজুড়েই কমে গেছে। এখন আসছে তথ্যের যুগ। তথ্য আর জ্ঞানতো এক না।
তারা বলেন, তথ্যের অবাধ প্র্রবাহ জ্ঞানের চর্চাকে খর্ব করছে পৃথিবী জুড়েই। জ্ঞান এখন পুরো পৃথিবীতে পণ্যে পরিণত হয়েছে, কেনা যায়। নিজের অনুশীলন বা গবেষণা দরকার হয় না। এটা কেনা যায়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরিস্থিতি আরো খারাপ।
আরও বলেন, আমরা দেখছি যে জ্ঞানের মূল্য এখন সমাজে নেই, রাষ্ট্রে নেই, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেখানে জ্ঞানের চর্চা থাকবে সেখানেও আমরা জ্ঞানের মূল্যটা আমরা দিতে পারছি না। প্রতিষ্ঠানের যিনি প্রধান হন, তিনি জ্ঞানানুশীলনের জন্য সেই জায়গায় যান না।
তার যোগ্যতাটা হচ্ছে তিনি দলের সাথে আছেন, রাজনৈতিক আণুকূল্য পাচ্ছেন, তদবীর করছেন …কাজেই তিনি কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন না, অনুপ্রাণিত করতে পারেন না। আবার যারা শিক্ষকতা পেশায় আছেন, এখানে উন্নতি নির্ভর করছে ওই দলীয় আনুগত্যের ওপর এবং সেজন্য গবেষণাও কমছে, প্রকাশনাও হচ্ছে না।
তারা বলেন, ‘উচ্চমান অর্জনের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি বা শিক্ষকদের গবেষণা, শিক্ষার্থীদের গবেষণাগার, পাঠাগার এগুলো কিন্তু উন্নতমানের থাকতে হয়। এখানেও কিন্তু আমরা অনেক পিছিয়ে পড়েছি’।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার পেছনে রাষ্ট্র ও সমাজে জ্ঞানীদের মূল্যায়ন না থাকার পাশাপাশি জ্ঞান চর্চার অনেক মৌলিক সমস্যারও সমাধান হয়নি।
তারা বলেন, জ্ঞানচর্চার পরিবেশও বাংলাদেশে স্বাধীন নয়। জ্ঞানের যে অনুশীলন সেটার সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা হলো মাতৃভাষার মাধ্যমে। মাতৃভাষার মাধ্যমে জ্ঞানের চর্চা না করলে সেই চর্চা গভীর হয় না, স্থায়ী হয় না, প্রভাবশালী হয় না। সেটা আমরা করতে পারি নাই’।
আরও বলেন, ‘আমরা অনুবাদ করতে পারিনি পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞানের বই। আমরা নিজেদের ভাষায় পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞানকে নিয়ে এসে সেই গ্রন্থ রচনা করতে পারিনি। আমরা সেটা সকলের কাছে পৌঁছে দিতে পারিনি। কাজেই জ্ঞান কিন্তু একজন দু’জনের ওপর নির্ভর করে না। জ্ঞান নির্ভর করে গোটা সমাজের ওপর। সমাজের যে কাঠামো আছে সেই কাঠামোর ওপর’।
বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে তালিকাভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে কাছাকাছি সময়ে স্বাধীন কোরিয়া এবং ভিয়েতনামে রয়েছে দীর্ঘ যুদ্ধের ইতিহাস। এসব দেশের অগ্রগতির পেছনেও একটা বড় কারণ হলো শিক্ষা এবং গবেষণায় বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ। বাংলাদেশে শিক্ষায় বিনিয়োগ এখনো কাঙ্খিত নয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪৬
আপনার মতামত জানানঃ