পাকিস্তান এখন ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য ধীরে ধীরে নরক হয়ে উঠছে। প্রতিদিনই সেখানে সংখ্যালঘুদের ওপর চলে অকথ্য অত্যাচার। তাত্ত্বিকভাবে, পাকিস্তানের সংবিধান সমস্ত নাগরিককে সমান অধিকার প্রদান করে, তবে এগুলি কেবল কাগজে কলমে রয়েছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু যেমন, হিন্দু, খ্রিস্টান, শিখ, বৌদ্ধ, আহমদি এমনকি শিয়ারাও দেশটিতে অ-নাগরিক হিসাবে বিবেচিত হয়। জাতিগত সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে জোরপূর্বক অপহরণ, ধর্ষণ, বলপূর্বক নিখোঁজ হওয়া এবং সামরিক বাহিনীর দ্বারা আটককৃতদের বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড প্রায়ই ঘটে থাকে এখানে। দেশটিতে সংখ্যালঘু সমাজের নারী বা মেয়েশিশুরা ধর্ষণ ও অপহরণের শিকার হচ্ছেন। এসবের বিরুদ্ধে এবার পাকিস্তানের সংখ্যালঘু মেয়েরা রুখে দাঁড়াচ্ছে। তারা কারাতে শিখছে আর পাল্টা আঘাত দিতে শুরু করেছে।
কারাতের মাধ্যমে নিজেদের রক্ষার উপায় শিখছে পাকিস্তানের শত শত সংখ্যালঘু নারী। এদের মধ্যে বেশিরভাগই হাজারা সম্প্রদায়ের সদস্য। দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় বেলুচিস্তান প্রদেশের কোয়েটা শহরে দশকের পর দশক ধরে সম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার হচ্ছে সংখ্যালঘু হাজারা সম্প্রদায়। আফগান বংশোদ্ভূত এসব শিয়া মুসলিম বসবাস করেন মূলত দুটি পৃথক ছিটমহলে।
একাধিক চেকপয়েন্ট এবং সশস্ত্র রক্ষী দিয়ে পরিবেষ্টিত হলেও এসব জায়গায় প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হতে হয় হাজারা নারীদের। গণপরিবহন ও বাজারের মতো উন্মুক্ত জায়গাগুলোতেও যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটছে অহরহ।
এধরনের হয়রানি থেকে বাঁচতে পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে ২৫টিরও বেশি মার্শাল আর্ট ক্লাবে আত্মরক্ষার উপায় শিখছেন অন্তত চার হাজার মানুষ। এর মধ্যে কোয়েটার বড় দুটি ক্লাবেই সদস্য রয়েছে প্রায় ৫০০ জন, যার মধ্যে বেশিরভাগই হাজারা নারী।
শুধু আত্মরক্ষাই নয়, এদের মধ্যে অনেকেই বিভিন্ন কারাতে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে অর্থ উপার্জন করছেন। সংখ্যলঘু এ সম্প্রদায় থেকে সম্প্রতি নার্গিস হাজারা নামে এক নারী জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন এবং কুলসুম হাজারা পদক জিতেছেন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায়।
রক্ষণশীল দেশ পাকিস্তানে এখনও খেলাধুলায় নারীদের অংশগ্রহণ বাঁকা চোখে দেখা হয়। অনেক সময় পরিবার থেকেই নিষেধ করা হয়। তবে মার্শাল আর্ট শিক্ষক ফিদা হুসেইন কাজমি মনে করেন, এর ব্যতিক্রমও হচ্ছে।
তিনি বলেন, সাধারণভাবে আমাদের সমাজে নারীরা প্রশিক্ষণ নিতে পারেন না… তবে নিজেকে এবং পরিবারকে রক্ষার খাতিরে তাদের অনুমতি দেয়া হচ্ছে।
কাজমি জানান, তিনি গত কয়েক বছরে শত শত নারীকে কারাতে শিখিয়েছেন।
৪১ বছর বয়সী এ শিক্ষক মাত্র ৫০০ রুপির বিনিময়ে সপ্তাহে ছয়দিন দুই ঘণ্টা করে কারাতে শেখান। তবে কারও পরিবারের কোনও সদস্য উগ্রবাদী সহিংসতায় নিহত হলে তাদের জন্য এই শিক্ষা ফ্রি।
নার্গিস বাটুল নামে ২০ বছরের এক তরুণী বলেন, ‘কারাতে দিয়ে হয়তো আমরা বোমা ঠেকাতে পারব না, তবে আত্মরক্ষার মাধ্যমে আমি আত্মবিশ্বাসী হতে শিখেছি। সবাই জানে আমি [মার্শাল আর্ট] ক্লাবে যাচ্ছি। এখন বাইরে বেরোলে কেউ [খারাপ] কিছু বলার সাহস পায় না।’
পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দেশটির বেলুচিস্তান প্রদেশে দীর্ঘদিন ধরে নৃশংসতা অব্যাহত রেখেছে। দীর্ঘদিনের নির্যাতন ও অত্যাচারে বেলুচিস্তানে পাকিস্তান সরকার কয়েক হাজার মানুষকে হত্যা করেছে, মানুষকে আশ্রয়হারা করেছে এবং বহু মানুষকে বসতি থেকে উচ্ছেদ করেছে। আর এসবের বিরুদ্ধে বরাবরই সোচ্চার ছিল স্বাধীনতাকামী বেলুচরা। এক্ষেত্রে তারা বাংলাদেশকে রোল মডেল মানেন। বেলুচিস্তানকে স্বাধীন করার নিমিত্তে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যে অস্ত্র তুলেছিলেন এখনো তা অব্যাহত রয়েছে।
বেলুচিস্তানে এরকম প্রায় আধা ডজন সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা আছে, যারা পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা বা বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য লড়ছে। বেলুচিস্তানে আরও যে প্রায় আধা ডজন বিচ্ছিন্নতাবাদী দল বা গোষ্ঠী সক্রিয়ভাবে স্বাধীন বেলুচিস্তানের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, তারা প্রায়শই তাদের আন্দোলনকে তুলনা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে।
বেলুচ, পশতুন এবং সিন্ধিদের মতো কিছু জাতিগত সংখ্যালঘুরা পাঞ্জাব অধ্যুষিত সামরিক ও আমলাতন্ত্র দ্বারা নির্যাতিত হয়। বেলুচিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলন এখানকার পাঞ্জাবি অধ্যুষিত সামরিক বাহিনীর দ্বারা সহিংসভাবে দমন করা হয়েছে। জাতিগত সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে জোরপূর্বক অপহরণ, ধর্ষণ, বলপূর্বক নিখোঁজ হওয়া এবং সামরিক বাহিনীর দ্বারা আটককৃতদের বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড প্রায়ই ঘটে থাকে এখানে।
সম্প্রতি পাকিস্তানে খ্রিষ্টান, শিখ, হিন্দু বা আহমদিয়াদের মতো ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা যে কী চরম দুর্দশা ও নির্যাতনের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন, তা নিয়ে একটি তীব্র সমালোচনামূলক রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা। বাস্তব জীবন থেকে একের পর এক উদাহরণ তুলে ধরে তারা দেখিয়েছেন, কীভাবে সেখানে সংখ্যালঘু সমাজের নারী বা মেয়েশিশুরা ধর্ষণ ও অপহরণের শিকার হচ্ছেন।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকারকর্মীরা বলেন, পাকিস্তানে বসবাসকারী সংখ্যালঘু নারীদের ওপর উগ্র মৌলবাদীরা ব্যাপক অত্যাচার চালায় এবং বাড়ি থেকে নারীদের তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে। নাবালিকা ও যুবতীদের অপহরণের পর বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করে। এখানে প্রতিবাদ করা মানে খুন হয়ে যাওয়া। এ ঘটনা সম্পর্কে ইমরান খানের প্রশাসন সম্পূর্ণ অবগত হয়েও নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। এভাবেই ধীরে ধীরে অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে পাকিস্তানের হিন্দু সম্প্রদায়সহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা, তাদের মুক্তির পথ জানা নেই। এসব ঘটনায় কোনো দৃশ্যমান বিচার আজ পর্যন্ত দেখা যায়নি, যা খুবই নিন্দনীয়।
তারা বলেন, পাকিস্তান অভিশপ্ত দেশ। লক্ষ লক্ষ মানুষকে তারা হত্যা করেছে। পাকিস্তানী সেনারা এখনও প্রতিনিয়ত বেলুচ, সিন্ধু ও গিলগিস্তান প্রদেশসহ বিভিন্ন প্রদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নৃশংস নির্যাতন-নিপীড়ন ও গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের লীলাভূমিতে পরিণত হয়েছে পাকিস্তান। এছাড়াও জঙ্গি উৎপাদনের প্রজনন কেন্দ্রও রয়েছে দেশটিতে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৩০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ