গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা থেকে ধীরে ধীরে স্বেচ্ছাচারী শাসন ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের এই যাত্রা অব্যাহত রয়েছে। এদিকে ভারতও একই দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য বাংলাদেশের চেয়েও খারাপ অবস্থানে ভারত। এমন তথ্য দিচ্ছে সুইডেনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ভ্যারাইটিজ অব ডেমোক্রেসির (ভি-ডেম) প্রতিবেদন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শাসনতান্ত্রিক দিক থেকে বাংলাদেশ আছে ‘নির্বাচনভিত্তিক স্বেচ্ছাতন্ত্র’ (ইলেকটোরাল অটোক্রেসি) বিভাগে। এর অর্থ হলো, এ দেশে গণতন্ত্র অপস্রিয়মাণ। আর সে জায়গায় ধীরে ধীরে স্থান করে নিচ্ছে স্বেচ্ছাচারী শাসন। অবশ্য বাংলাদেশের অবস্থান আগের প্রতিবেদনেও এমনটাই ছিল। অর্থাৎ গণতন্ত্রের প্রকৃতিগত হিসাবে এ দেশের অবস্থান অপরিবর্তিত আছে।
এছাড়া নির্বাচনভিত্তিক গণতন্ত্র থেকে ভারত নেমে এসেছে নির্বাচনভিত্তিক স্বৈরতন্ত্রের স্তরে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ হিসেবে পরিচিত ভারত গত ১০ বছরে ক্রমাগত গণতন্ত্র থেকে একনায়কতন্ত্রের দিকে হাঁটছে।
পাঁচ বছর ধরে বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে সুইডেনের গোথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভি-ডেম ইনস্টিটিউট। এবারের প্রতিবেদনের শিরোনাম ‘অটোক্রাটাইজেশন গোজ ভাইরাল’।
সংস্থাটির গণতন্ত্রের পনেরতম প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, তারা ১৭৮৯ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বিশ্বের ২০২টি দেশের ৩০ মিলিয়ন ডেটা পয়েন্টসহ গণতন্ত্রের বৃহত্তম ডেটাসেট তৈরি করেছে।
কোভিড -১৯ মহামারি শুরু হওয়ার পরপরই ভি-ডেম ইনস্টিটিউট ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৪৪টি দেশে মহামারির ফলে রাষ্ট্রীয় প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব শনাক্ত করতে প্যান্ডেমিক ব্যাকস্লাইডিং প্রকল্প (প্যানডেম) শুরু করেছিল। প্রকল্পে কয়েক ধরনের লঙ্ঘন যেমন- সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বৈষম্য, মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন, অতিরিক্ত পুলিশি শক্তি প্রয়োগ এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার উপর বিধিনিষেধ পরিমাপ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে ‘নির্বাচনভিত্তিক গণতন্ত্রের সূচকে’ (ইলেকটোরাল ডেমোক্রেসি ইনডেক্স) বাংলাদেশের অবনমন হয়েছে। এই সূচকে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান ১৩৮তম, স্কোর শূন্য দশমিক ২৭। স্কোর কমেছে প্রায় শূন্য দশমিক ০৩১।
ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন সূচকে, গত ১০ বছরে বাংলাদেশের গণতন্ত্র হ্রাস পেয়েছে ১৫% হ্রাস পেয়েছে, যেখানে ভারতের ৩১% হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে নেপালের ১০% ও ভুটানের ২% হ্রাস পেয়েছে। কেবলমাত্র শ্রীলঙ্কার গত ১০ বছরে ২০% বৃদ্ধি পেয়েছে।
সিভিল লিবার্টি ইনডেক্সে বাংলাদেশের ১২%, ভারতের ১২%, পাকিস্তানের ১৩% এবং নেপালের ১০% হ্রাস পেয়েছে, বিপরীতে শ্রীলঙ্কার ১২% এবং ভুটান ১% বৃদ্ধি পেয়েছে সিভিল লিবার্টি বৃদ্ধি পেয়েছে।
সংবাদমাধ্যমের ওপর কড়াকড়ি, মানহানি ও রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের অপব্যবহারের কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে ভারতকে ‘বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র’ থেকে ‘নির্বাচনি স্বৈরাচার’ এর ধাপে নামিয়ে আনা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নির্বাচনে জিতে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার সঙ্গে এই অবনমনের নিবিড় সম্পর্ক আছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচনি স্বৈরাচার’ বর্তমানে সর্বাধিক জনপ্রিয় শাসন ব্যবস্থা এবং বিশ্বের ৮৭ দেশ এবং ৬৮% মানুষ এই ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে।
এছাড়া ২৫টি দেশের মানুষ স্বৈরাচারীকরণ প্রক্রিয়ার মধ্যেই রয়েছে, যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ বা ২.৬ বিলিয়ন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্রাজিল, ভারত, তুরস্ক এবং আমেরিকার মতো বেশ কয়েকটি জি-২০ ভুক্তদেশ এই প্রক্রিয়া বিস্তারের অংশ।
এতে আরও বলা হয়, পুরোপুরি গণতন্ত্র কার্যকর রয়েছে, গত ১০ বছরে এমন দেশের সংখ্যা ১৬-তে নেমে এসেছে। ফলে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার মাত্র ৪% প্রকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আওতায় রয়েছে।
নির্বাচনি গণতন্ত্র সূচকে বাংলাদেশের সূচক ১২%, ভারতের ২৫%, পাকিস্তানের ৯% হ্রাস পেয়েছে। তবে নেপালের (২%) এবং শ্রীলঙ্কার উভয়েরই বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়েই স্বেচ্ছাচারী শাসনের প্রভাব বেড়ে চলেছে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা আছে পোল্যান্ডে। করোনা মহামারির কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। মহামারি সামাল দেওয়ার কথা বলে অনেক দেশে গণতান্ত্রিক কাঠামোর ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। তবে অনেক গণতান্ত্রিক দেশ এই সময়টাতে দায়িত্বপূর্ণ আচরণ করার চেষ্টা করেছে। ৯টি দেশে মারাত্মক ও ২৩টি দেশ আন্তর্জাতিক নিয়মের পরিমিত মাত্রায় লঙ্ঘন করেছে। পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ হয়েছে ঘোষিত একনায়কতান্ত্রিক দেশগুলোতে, ৫৫টি দেশেই আন্তর্জাতিক নিয়মের লঙ্ঘন হয়েছে বেশি।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ্বজুড়ে শাসনকাঠামোর দিক থেকে নির্বাচনভিত্তিক স্বেচ্ছাতন্ত্র এখন সবচেয়ে সাধারণ ধরন। এর সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। সব মিলিয়ে পুরোপুরি ও আংশিক স্বেচ্ছাতন্ত্রের দেশগুলোতে আছে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৬৮ শতাংশ। অথচ ২০১০ সালে এটি ছিল ৪৮ শতাংশ। আর উদার গণতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা কমে হয়েছে ৩২টি। মোট বৈশ্বিক জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ রয়েছে এই দেশগুলোতে। ইলেকটোরাল ডেমোক্রেসি আছে ৬০টি রাষ্ট্রে। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১৯ শতাংশ আছে এসব দেশে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী উদার গণতন্ত্রের ধারাবাহিক অবনমন হচ্ছে। বিশেষ করে প্রশান্ত মহাসাগরীয় এশিয়া, মধ্য এশিয়া, পূর্ব ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকায় এ বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। ব্রাজিল, ভারত, তুরস্কসহ মোট ১০টি দেশে গণতান্ত্রিক পরিস্থিতির সবচেয়ে বেশি অবনমন হয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি দেশ হয়ে গেছে পুরোপুরি একনায়কতান্ত্রিক।
প্রতিবেদন অনুসারে, ডেনমার্ক, সুইডেন, নরওয়ে, কোস্টা রিকা, সুইজারল্যান্ড, নিউ জিল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, জার্মানি, এস্তোনিয়াত ও নেদারল্যান্ডসের এলডিআই সূচক সর্বোচ্চ।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘ভি-ডেমের মতো আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা সূচক দিয়ে অবস্থা দেখায়। আমরা তো বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিজ চোখে দেখছি, অনুভব করছি। আমরা প্রতিনিয়তই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিচে নামা প্রত্যক্ষ করছি।’
তারা বলেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র ছিল নির্বাচনসর্বস্ব। এটাও এখন নেই।
তারা বলেন, দু:খের বিষয় আমাদের অতীতের গণতান্ত্রিক গৌরবজনক ঐতিহ্যকে আমরা এখন কালিমালিপ্ত করে চলতে বসেছি। জনগণের আন্তরিক সমর্থনের ভিত্তিতে, দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে জোরদার করে তোলার পরিবর্তে যে কোন মূল্যে ক্ষমতায় যাওয়া ও ক্ষমতায় টিকে থাকা আমাদের এক শ্রেণীর রাজনীতিকের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফল দাঁড়িয়েছে এই যে ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার যাওয়াতে আমরা এখন আর লজ্জা পাই না। আমরা উল্টো প্রধান বিরোধীদল নির্বাচন বয়কট করায় এই বলে সংসদে আনন্দ প্রকাশ করি যে, বিরোধী দল নির্বাচন বয়কট করায় এক হিসাবে ভালই হয়েছে। সংসদে তাদের খিস্তিখেউর শুনতে হচ্ছে না।
তারা বলেন, বিরোধী দলের বক্তব্যকে যারা খিস্তিখেউর বলে মনে করেন, তারা কি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী? গণতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে বিরোধী চিন্তাধারার প্রতি সহনশীল, শ্রদ্ধাশীল হওয়া।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাধীনতা আমাদের সব আশা পূর্ণ করেনি। দারিদ্র্যকে অনেকটা তাড়িয়েছে। দুর্নীতিকে তাড়াতে পারেনি। দুর্নীতি আরও বড় আকারে দেখা দিয়েছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সন্ত্রাস। ৫০ বছরে আমাদের অনেক উন্নয়ন ঘটেছে। তার ফসল খেয়ে ফেলছে এ দুর্নীতি ও সন্ত্রাস। আগে যুদ্ধটা ছিল বিদেশি শাসক-শোষকদের বিরুদ্ধে। এখন তাদের স্থান দখল করেছে দেশি শাসক-শোষক। তারা আরও ভয়ংকর।
তারা বলছেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের এ পঙ্গুত্ব দূর করার জন্য একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক বিরোধী দল চাই। একটি দল দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকলে তার ভেতর ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রবণতা দেখা দেয়। দুর্নীতি জন্ম নেয়। বাংলাদেশে আজ সেই অবস্থা। এ অবস্থা থেকে দেশকে উদ্ধারের একমাত্র পথ গণতন্ত্রের পঙ্গুত্ব দূর করা এবং স্বাধীনতার মূল আদর্শগুলো ধর্মান্ধদের কবল থেকে মুক্ত করা। এ লক্ষ্যের পথে আমাদের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ধীরে ধীরে চেতনা জাগ্রত হচ্ছে এটাই আশার কথা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩১৫
state watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ