ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের প্রতিবাদে হেফাজত ইসলামের পক্ষ নিয়ে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের পদত্যাগের হিড়িক পড়েছে। আওয়ামী লীগ ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে, ভাস্কর্যকে হালাল মনে করে, মুসলমানদের ওপর নির্যাতন করে ইত্যাদি অভিযোগ এনে আওয়ামী লীগে কোনো মুসলমান থাকতে পারে না জানিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে পদত্যাগ করছেন অনেকেই।
এদের মধ্যে আছেন সিলেটের জকিগঞ্জ পৌরসভার ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি মাজেদ আহমেদ, হবিগঞ্জ পৌর ছাত্রলীগের যুগ্ম আহবায়ক হেলাল উদ্দিন জনি, হবিগঞ্জ সদর উপজেলার লস্করপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের যুগ্ম আহবায়ক মুহসিন আহমেদ মুন্না এবং হবিগঞ্জ পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রবিউল আলম আকামিন।
গত শনিবার(২৭ মার্চ) রাতে তার নিজের ফেসবুক আইডি থেকে এক স্ট্যাটাস দিয়ে ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করেন সভাপতি হাফিজ মাজেদ। সিলেটের জকিগঞ্জ পৌরসভার ৫নং ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি হাফিজ মাজেদ।গত ২৭ মার্চ রাতে তার নিজের ফেসবুক আইডি থেকে এক স্ট্যাটাস দিয়ে ছাত্রলীগ ছাড়ার ঘোষণা দেন তিনি। ২৯ মার্চ (সোমবার) বিকেলে দ্বিতীয় দফায় আরেকটি স্ট্যাটাস দিয়ে তার পদত্যাগের যুক্তি খণ্ডন করেন।
মো. হাফিজ মাজেদ ফেসবুক স্ট্যাটাসে জকিগঞ্জ পৌরসভা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে উদ্দেশ্য করে লেখেন, ‘মুসলিম জনতার মানবতাকে উপেক্ষা করে ভারতের ইসলাম বিদ্বেষী, সীমান্ত হত্যাকারী, কাশ্মীর দখলকারী, কসাই মোদিকে দেশে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য ও নামাজি মুসলমানদের ওপর বর্বর নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের মতো ঘৃণ্যতম কাজের কারণে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে পৌরসভার ৫নং ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করলাম।’
তিনি আরও লেখেন, ‘যে দল ইসলামকে সম্মান দিতে জানে না, বিশ্ব নবীর সুন্নতকে টানাটানি করে, যারা ভাস্কর্যকে হালাল মনে করে, মুসলমানদের ওপর হামলাকারী চা-বিক্রেতা মোদিকে দেশে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানায়, সেই দলে কোনো মুসলমান থাকতে পারে না। তাই আমিও সেই দলে থাকতে পারি না। আজ থেকে বয়কট করলাম ছাত্রলীগ।
তিনি বলেন, যদি কখনো বঙ্গবন্ধুর পূর্ণ আদর্শ ছাত্রলীগের মধ্যে ফিরে আসে এবং তারা ভারতের দালালি চাটুকারি বাদ দেয়। দেশের আলেমসমাজকে সম্মান দেয় তখন চিন্তা করব যে পূনরায় সংগঠনটিতে ফিরে আসা যায় কি না। এর পূর্বে দালালদের সাথে আমি আর দালালিতে নেই।’
তার আগে গত শুক্রবার(২৬ মার্চ) রাতে হবিগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগ বরাবর নিজের ফেসবুক আইডি থেকে হবিগঞ্জ পৌর ছাত্রলীগের যুগ্ম আহবায়ক হেলাল উদ্দিন জনি এক স্ট্যাটাসে লেখেন, আমি হেলাল উদ্দিন জনি, হবিগঞ্জ পৌর ছাত্রলীগের যুগ্ম আহবাক। আজকে মুসলিম জনতার মতামতকে উপেক্ষা করে ভারতের ইসলাম বিদ্বেষী, সীমান্ত হত্যাকারী, কাস্মীর দখলকারী, কসাই, সন্ত্রাস মোদিকে দেশে আমন্ত্রণ জানানোর কারণে এবং নামাজি মুসলমানদের ওপর বর্বর নির্যাতন ও ঘৃণ্যতমভাবে মুসলমানদের ওপর গুলি করার কারণে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে আমি হবিগঞ্জ পৌর ছাত্রলীগের যুগ্ম আহবায়কের পদ থেকে পদত্যাগ করলাম।
নিজ ফেসবুক আইডি থেকে এক স্ট্যাটাসে হবিগঞ্জ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ রবিউল আলম আকামিন বলেন, আমি মোহাম্মদ রবিউল আলম আকামিন, হবিগঞ্জ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ছাত্রলীগের ১ম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, আমি স্বেচ্ছায় হবিগঞ্জ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করলাম। আজকে থেকে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী অঙ্গসংগঠনে আমার কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই। যে দেশে ভিনদেশী এক খুনির জন্য স্বদেশের মানুষ খুন করে, আমার আলেমদের মারধর করে, আমার নবীর সুন্নতে আঘাত করে, আমি সেই সংগঠনের সাথে নেই। আমার এই ত্যাগটুকু শুধুমাত্র আমার আল্লাহর জন্য।
এদিকে ফেসবুকে একই কথা লিখে লস্করপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের যুগ্ম আহবায়কের পদ থেকে পদত্যাগ করেন মহসিন আহমেদ।
এমন বিতর্কিত পোস্ট দেয়ার পর থেকে সর্বত্র তোলপাড় হচ্ছে। তৃণমূল ছাত্রলীগ নেতাদের মাঝে চরম ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
তৃণমূল ছাত্রলীগের একাধিক নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, রাজপথের ত্যাগী কর্মীদের বাদ দিয়ে ও অবমূল্যায়ন করে ছাত্রলীগের কমিটিতে অনুপ্রবেশকারী ও অন্য দলের এজেন্টদেরকে পদপদবী দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছে। তাছাড়াও বিভিন্ন ভুইফোঁড় সংগঠনের নামেও শিবির-ছাত্রদলসহ বিরোধী সংগঠনের নেতাকর্মীদেরকে আওয়ামী ব্যানারের নিচে নিরাপদে স্থান করে দেয়া হয়েছে। সুযোগ পেলে তারাই সংগঠনকে বিতর্কের মাঝে ফেলে দেয়। পদপদবী দেবার সময় ত্যাগীদের বঞ্চিত করার কারণে বৃহৎ সংগঠনটি কঠিন সময়ে কলঙ্কিত হয়।
তারা আরও জানান, উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন কমিটিসহ ওয়ার্ড কমিটিগুলোতেও অনুপ্রবেশকারী অসংখ্য পদধারী রয়েছে। এই অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির মাঝে আছেন দলের কঠিন সময়ের পরীক্ষিত কর্মীরা। সুদিনে অনুপ্রবেশকারীরা সংগঠনের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকায় তাদের দাপটে প্রকৃত ছাত্রলীগ কর্মীরা খুবই অসহায়। ত্যাগী অনেকজন অনুপ্রবেশকারীর কনুই ঠেলায় রাজনীতি থেকেও দূরে সরে গেছেন। দলের ভিতর অনুপ্রবেশকারীরা ছদ্মবেশে ঘাপটি মেরে পদপদবী নিয়ে বসে আছে বলে প্রকাশ্যে বহু অভিযোগ রয়েছে। সরকার বিরোধী আন্দোলনের সময় তারাই রাজপথে না গিয়ে ধর্মের বাহানা সামনে এনে নীরব ভূমিকা পালন করে।
অভিযোগ রয়েছে, কতিপয় নেতারা তাদের বলয় গড়তে বিরোধী সংগঠন থেকে আগত নেতাকর্মী দিয়ে বলয় বৃহৎ করে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করেছেন। বিরোধী সংগঠনের সমর্থকরাও তাদের প্রশ্রয়ে নিরাপদে আছেন। সিনিয়র নেতাদের এমন কর্মকাণ্ডেও ক্ষোভ আছে অনেকের মনে। এখনই এদেরকে চিহ্নিত করে দ্রুত সময়ের মধ্যে দল থেকে বহিষ্কার করতে তৃণমূল কর্মীরা দাবি জানিয়েছেন।
তবে জকিগঞ্জ পৌরসভা ছাত্রলীগের সভাপতি নুরুল আমিন বলেন, পৌরসভা ছাত্রলীগে কোনো অনুপ্রবেশকারী নেই। ওয়ার্ড কমিটিগুলোতে অনেক যাচাই বাছাই করে পদপদবি দেয়া হয়েছে। তবে ছাত্রলীগের বিভিন্ন গ্রুপে অনুপ্রবেশকারী আছেন বলে স্বীকার করেছেন।
পৌরসভা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানজিম শাহরিয়ার জাতীয় এক দৈনিককে জকিগঞ্জ পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি হাফিজ মাজেদ বিষয়ে বলেন, ২০১৯ সালে পৌরসভার ওয়ার্ডগুলোতে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক তিনটি পদে কমিটি করা হয়েছিল। সে সময় ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতির দায়িত্ব পেয়েছিলেন হাফিজ মাজেদ। হাফিজ মাজেদের বাবা ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। দলে অনুপ্রবেশকারী ঠেকাতে পুরো যাচাই-বাছাই করেই তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তার বাবা মারা যাওয়ার পর পরিবারের হাল ধরতে গত বছরের প্রথম দিকে তিনি সৌদি আরবে চলে যান। সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, সে সময় থেকেই তার দলের কোনো দায়িত্বে থাকার কথা না।
তানজিম শাহরিয়ারের ভাষ্য, হাফিজ মাজেদ যদি মনে করে থাকেন দেশের বাইরে অবস্থান করেও তিনি দায়িত্বে আছেন, তবে সেটি বোকামি হবে। সংগঠনে না থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হতে তিনি এমন স্ট্যাটাস দিয়ে থাকতে পারেন বলে মন্তব্য করেন শাহরিয়ার।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একের পর এক সংঘর্ষ ও খুনের ঘটনাসহ বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য বারবার আলোচনায় আসে ছাত্রলীগ। মাদক ব্যবসা, টেন্ডার-বাণিজ্য, পুলিশকে মারধরসহ একের পর এক নানা অভিযোগ উঠেছে সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। ছাত্রলীগ যে আদর্শ ও নীতিতে একটি সংগঠনে রুপ নিয়েছিল সেই আদর্শ এখন আর নেই। বিশ্লেষকরা বলেছেন, আদর্শের চর্চা না থাকার ফলে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেতারা দুর্নীতিসহ নানান অনিয়মের সাথে জড়িয়ে পড়ছে।
তারা মনে করেন, আওয়ামী লীগের এই সর্বগ্রাসী নতুন রাজনৈতিক আদর্শ ও ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে যাকে পারো তাকে ধরো, আওয়ামী লীগ করো নীতিতে চলতে গিয়ে ছাত্রলীগ আর আগের মতো আদর্শিক ছাত্রলীগ হতে পারছে না। তারা মনে করেন, ছাত্রলীগ এখন আর ছাত্রলীগের সঙ্গে আদর্শিকভাবে নেই। তারা কোনো ভাই বা সিন্ডিকেটের রাজনীতি করছে। তাদের ভাষ্যমতে, সিন্ডিকেট হলো তারাই, যারা ছাত্রলীগকে ব্যবহার করে অর্থ, সম্পদ, বিত্ত, বৈভব বানিয়েছে। আর ছাত্রলীগও তাদের ব্যবহার করে ধান্দার রাজনীতি করছে।
তারা বলেন, আওয়ামী লীগ দলটির মতই ছাত্রলীগের অবস্থা। হেফাজত ইসলামসহ মুসলিম দলগুলোর সাথে আতাত করে ক্ষমতা ধরে রাখার অপরাজনীতির চর্চাই দলসহ সংগঠনগুলোকেও ডুবাবে আওয়ামী লীগ। যে উদ্দেশ্য নিয়ে আওয়ামী লীগ হেফাজতসহ ইসলামী দল কাছে টেনে রাজনীতি করছে, একই উদ্দেশ্যে ছাত্রলীগও আদর্শের বাইরে গিয়ে যাকে তাকে সংগঠনে ভিড়াচ্ছে। ফলে রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে হেফাজত যেভাবে মাঠে নেমেছে, প্রতিপক্ষ হয়ে এখন গলায় কাঁটা বিধাচ্ছে, ছাত্রলীগের অবস্থাও তাই।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৩০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ