শুভ্র সরকার : বুড়িগঙ্গার তীরে মাঝিদের এক মুহূর্ত নেই বিশ্রাম নেবার। ঘাটে ভিড়তেই যেন শুরু হয়ে যায় ফেরার তাড়া। এদিকে অনবরত ফেরী পারাপার তো চলছেই। এই আমাদের ব্যস্ত ঢাকা।
মাঝিরা যাত্রীদের তুলে নেয় সদরঘাট থেকে। সদরঘাট হল ঐতিহাসিক বাণিজ্য কেন্দ্র যা এই শহরটাকে গড়ে উঠতে দেখেছে। অনেকটা যেন, এই সদরঘাটই পেলেপুষে বড় করেছে ঢাকা শহরকে। এরপর মাঝিরা নদীর বুক চিরে পৌঁছে দেয় যার যার গন্তব্যে, হয়তো সেই সেই নিবাসে দুই দশক আগেও ছিল অবারিত ফসলের মাঠ। যার টিকিটিও আজ আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
পুরনো ঢাকা এখন আর এই শহরটার অর্থনীতি এবং রাজনীতির কেন্দ্রস্থল নেই। কিন্তু সদরঘাট আজও স্বমহিমায় উজ্জ্বল। আজও সেখানকার কর্মব্যস্ততায় আপনি পাবেন ঢাকা শহরের গন্ধ। অসংখ্য মানুষ, তাদের হাকডাক, পিঁপড়ের সারির মতো অজস্র নৌকা, ঘরে ফেরা মানুষ, টাকা গুনে নেয়া আঙুলের আনন্দ, জুতোর আর্তচিৎকার, গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষের ভীতসন্ত্রস্ত চোখ আপনাকে কানেকানে ঢাকা শহরের নাম বলে দেবে।
১৯৭১ এর ২৬ মার্চ থেকে স্বাধীনতার এই ৫০ বছরে বাংলাদেশের যে পরিবর্তন পরিবর্ধন, তা আপনি বুঝতে পারবেন ঢাকা শহরের দিকে তাকালে। পাকিস্তানের কয়েক দশকের অবহেলা অত্যাচারে ঢাকা তখন ধুঁকতে থাকা কিশোর। ছোট একটি শহর, কয়েক লক্ষ মানুষ। ভাত কাপড়ের চিন্তায় দিনের আলো কখন বুড়িগঙ্গা মরতে ঝাপ দেয়, কারও হয়তো খেয়ালেই আসত না।
এখন ঢাকা টগবগে তরুণ। স্ফীত পেশী। রোদ পড়ে ঘামে ভেজা চওড়া কাঁধে, তুলে নিয়েছে গোটা পুরো দেশের দায়ভার যেন। এখন প্রায় ২ কোটি মানুষের বাস এই ঢাকা শহরে। প্রতি বছর আরও জুটছে প্রায় ৪ লাখ মানুষ। কীভাবে কীভাবে যেন ঢাকা সবার জন্য জায়গা করে দেয়। সুউচ্চ অভিজাত বাসভবনে অথবা রাস্তার পাশে, ওভারব্রীজে কিংবা রেলস্টেশনে। তবু কাউকে নিরাশ করে না ঢাকা। আপনি বাঁচতে পারবেন, চাইলে মরতেও। তবে ছাড়তে পারবেন না।
১৯৬৬ সালে আসাদুজ্জমান দেশের পশ্চিমাঞ্চলের জেলা ঝিনাইদহ থেকে ব্যবসার উদ্দেশ্যে ঢাকায় পাড়ি জমান। তখনও পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী শহর এটি।
“এই শহর অনেক ছোট ছিল। তিনতলা দালানই কদাচিৎ চোখে পড়ত। সচারচর টিনের চাল দেখা যেত। প্রচুর পুকুর খাল আর অল্প কিছু মানুষ নিয়ে ঢাকা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা এক শহর। শান্তির শহর”, আসাদ বলেন।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে স্বাধীনতার পর, আসাদ মোহাম্মদপুরে থিতু হন। শহরের উত্তরাঞ্চলের বুকে মোহাম্মদপুর এখনও মুহূর্মুহু নিজেকে বদলে নিচ্ছে। ঢাকা খুব দ্রুতই বিস্তৃত হচ্ছে। সরকার দেশের ভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা মানুষদের বসবাসের জন্য আশপাশে জায়গা বরাদ্দ করে দিয়েছিল। মানুষকে রাজধানীমুখি করেছিল। কিছু জায়গায় খাল ভরাট করে, কৃষিজমি উজাড় করে মানুষ বসত শুরু করেছিল এই শান্তির শহরে।
১৯৭১ সালে হেনরি কিসিনগার বাংলাদেশকে তলাহীন ঝুড়ির অর্থনীতি বলে আখ্যা দিয়েছিল। আজ অর্ধশতক পর এদেশ গর্ব করতে পারে। হেনরি কিসিনগারকে ভুল প্রমাণ করার সমস্ত অর্জনটাই এদেশের মানুষের।
দ্য ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড (আইএমএফ) ভবিষ্যতবাণী করেছে, করোনা মহামারী গতবছরের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে নামিয়ে অর্ধেকে নিয়ে আসলেও এবছর প্রবৃদ্ধির হার ৪.৪% অব্দি অর্জিত হবে।
এই ক্রমবর্ধমান অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে ঢাকা শহর ভিত্তিক শিল্পকারখান। যার উপর ছড়ি ঘোরাচ্ছে শহরের কিছু ধনীক শ্রেণী। ঝা চকচকে অ্যাপার্টমেন্টে যাদের বাস। যারা কেনাকাটা করে নামিদামি শপিংমলগুলোতে। এই শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শ্রমিক হিসেবে আছে সারাদেশ থেকে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করতে ঢাকায় আসা মানুষগুলো। যারা সাধারণত বসতি গড়ে তুলছে কল্যানপুর এবং কড়াইল বস্তিতে। কিংবা ঢাকা ও গার্মেন্টস কারখানার জন্য গড়ে তোলা স্যাটেলাইট টাউনের মাঝের ছোট শহরগুলোতে। মালিক আর শ্রমিক শ্রেনীর এই ফারাক ঢাকা শহরের চিরচেনা বৈশিষ্ট্য।
কড়াইল ঢাকার অন্যতম বড় বস্তি। যা প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কাজের সন্ধানে শহরে ভীড় করা মানুষগুলোকে নিজের পেটে স্থান দেয় রোগেভোগা অসুস্থ মায়ের মতো।
“এখানে সমস্যা আছে। এখানে কাজও আছে। আমার গ্রামে থাকার মতো অবস্থা নেই বলেই, এখানে এসেছি নতুন করে কিছু করতে,” পারভিন বেগম বলেন। বয়স ৪৫। তার গ্রাম উপকূলীয় ভোলা জেলায় যা কিনা বেশ আগেই বন্যায় গ্রাস করে নিয়েছে নদী।
সে থাকছে কল্যানপুরে। সরকার থেকে বরাদ্দকৃত জায়গায় গড়ে ওঠা বস্তিতে। কাজ করছে গার্মেন্টস কারখানায়। প্রায় দশক ধরে আছে সে। বাঁশ দিয়ে তৈরি ছোট্ট ঝুপড়িগুলোকে সে বদলে যেতে দেখেছে টিনের তৈরি ছোট ছোট ঘরে। এরপর আরেকটু পোক্ত হয়েছে তবু একটু জোরে হাওয়া দিলে ঘরের বাইরে যেয়ে দাঁড়াতে হয়। রাত কাটানো যায়, জীবন না।
“এই নোংরা বস্তিতে আমরা থাকতে চাই না। আমরা সবসময় চাই যেন ফিরে যেতে পারি।”
পারভিন এবং তার স্বামী প্রতিমাসে একটি মাত্র ঘরের ভাড়া দেন দু’হাজার টাকা। সেখানে সবসময় লাইট জ্বালিয়ে রাখতে হয়, কেননা স্বাভাবিক বিদ্যুৎসংযোগ সেখানে নেই। ঘরের বাইরে নর্দমা প্রায়ই ভরে ওঠে। দুর্গন্ধ, মশা, গরম নাজেহাল করে রাখে।
“এমন না যে আমি এখানে খুব ভালো আছি। তবে গ্রামের থেকে এখানে কাজের সুযোগ অনেক”, তিনি বলেন।
পারভিন যখন ঢাকায় এসেছিল, সে বেতন পেত মাসে মাত্র ৩০০ টাকা। যা বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৬০০ টাকায়। পারভিন বিশ্বাস করেন, গ্রামের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিনিয়োগ না বাড়ালে, শহরগামী মানুষের স্রোত আরও দীর্ঘ হবে। চাপ বাড়বে ঢাকার উপর। পরিস্থিতি আরও করুণ হবে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য।
“পুরো ঢাকাকেই আমার বস্তি মনে হয়। শুধুমাত্র ভালো একটা অ্যাপার্টমেন্টে থাকলেই আপনি শহুরে আধুনিক জীবন পাচ্ছেন বলে দাবি করতে পারেন না”
জাতিসংঘের সূত্র মতে, ২০৩০ এর মধ্যে ঢাকা হবে বিশ্বের চতুর্থ জনবহুল মেগাসিটি। যদিও খুব কম সংখ্যক মানুষ বিশ্বাস করে, ঢাকা এর জন্য প্রস্তুত আছে।
পরিকল্পনা ছাড়াই বসতবাড়িগুলো বহুতল হচ্ছে। পাশাপাশি বিল্ডিংগুলোর মধ্যে ফাঁক সামান্যই। বৈদ্যুতিক অসংখ্য তার বিপদজনকভাবে ঝুলে থাকে রাস্তায়। শহরের নিষ্কাশন ব্যবস্থা এখনও মান্ধাতা আমলের। বৃষ্টি হলেই শহরের রাস্তায় ময়লা জমে যায়, ড্রেনগুলো উপচে পড়ে। দুর্ভোগ বাড়ে সাধারণ মানুষের।
ঢাকার বায়ুর বিশুদ্ধতার মান বিশ্ব তালিকায় একেবারে নিচের দিকে। ধুলোর এই শহরে প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে ভুলে গেছে মানুষ। শহরের রাস্তাগুলো যানজটে ঠাঁসা। এক দশক আগে ঢাকা শহরে যানবাহনের স্বাভাবিক গতি ছিল প্রতি ঘন্টায় ১৩ মাইল। যা এখন কমে দাঁড়িয়েছে মানুষের হাঁটার গতিতে, প্রতি ঘন্টায় মাত্র ৪ মাইল।
“পুরো ঢাকাকেই আমার বস্তি মনে হয়। শুধুমাত্র ভালো একটা অ্যাআপার্টমেন্টে থাকলেই আপনি শহুরে আধুনিক জীবন পাচ্ছেন বলে দাবি করতে পারেন না”, বলেন ড. শাহাদাত হোসেইন, টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব ডর্টমুন্ড-এর একজন নগর পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞ।
তিনি বলেন, শহরে আপনি কোন পার্ক দেখবেন না। বাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছে। এরপর বাড়ি ফিরে, সারাদিন বাড়িতেই অবস্থান করছে। নেই কোন সামাজিক পরিকাঠামো। এই শহরে আপনার সম্পর্ক শুধু আপনার অ্যাপার্টমেন্ট, কর্মক্ষেত্র, বাচ্চাদের স্কুলের সাথে। আর কোথাও কোন কিছুর সাথে আপনার সম্পর্ক নেই। এর কারণ অপরিকল্পিত সড়কব্যবস্থা, যানজট সমস্যা। এ জন্য যে লোকালয়ে আপনি বাস করছেন, তা সম্পূর্ণ অপরিচত আপনার কাছে।
হোসেইন বলেন, যখন শহরে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো বিস্তৃত হয়েছে, তখন শহরের আবাসন নিয়ে কর্তৃপক্ষের কার্যকর কোন পদক্ষেপ ছিলো না। দুর্নীতি পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করেছে। ক্ষমতাশীলদের জন্য আইনকে করেছে নমনীয়। উদাহরণ হিসেবে কেরানীগঞ্জের কথা বলা যায়। সাশ্রয়ী মূল্যে আবাসনের জন্য সেখানে জমি কিনে এখন বিক্রি করা হচ্ছে এমন চড়া দামে যা সাধারণ শ্রমিকশ্রেণীর পক্ষে বহন করা সম্ভব না।
যদি এই অপরিকল্পিত উন্নয়ন চলতে থাকে, শীঘ্রই এই প্রাণের শহর ঢাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে।
আসাদুজ্জামান আসাদে ১৯৬৬ সালে আসা সেই ছোট্ট শহরটার এই মেগাসিটি হয়ে ওঠার জার্নিতে অনেক সুবিধাই দেখতে পান। তার ব্যবসা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আয়ের নিত্যনতুন পথ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু সে ভয় পাচ্ছে, শহরটা ক্রমেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে।
আমাদের প্রয়োজন বিকেন্দ্রীকরণ, আমাদের প্রয়োজন গ্রামে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন, উন্নত শিক্ষা এবং উপার্জনের পথ। আমরা খুব সহজেই ঢাকার ভবিষ্যত ভেবে নিতে পারি। যদি এই অপরিকল্পিত উন্নয়ন চলতে থাকে, শীঘ্রই এই প্রাণের শহর ঢাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে, তিনি বলেন।
মূল প্রতিবেদন: দ্য গার্ডিয়ান
এসডব্লিউ/এসএস/২৩০৪
আপনার মতামত জানানঃ