বায়ুদূষণের দিক থেকে গত তিন বছরের মতো এবারও বিশ্বের শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। রাজধানী ঢাকাও বিশ্বের দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে বরাবরের মতোই দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান পরিমাপকারী সংস্থা আইকিউএয়ারের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। বায়ু দূষণে বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে পাকিস্তান (৫৯.০) ও তৃতীয় স্থানে ভারত (৫১.৯)।
সংস্থাটি বায়ুর মান পরিমাপে ফুসফুসের জন্য ক্ষতিকর পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পিএম২.৫ বলে পরিচিত বস্তুকণার ঘনত্বের ভিত্তিতে এই তালিকা তৈরি করেছে। পৃথকভাবে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশ ও রাজধানীর তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এই প্রতিবেদনে ১০৬টি দেশের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
তালিকায় টানা তৃতীয়বারের মতো বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত রাজধানী চিহ্নিত হয়েছে ভারতের নয়াদিল্লি। এক্ষেত্রে ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। ঢাকার বায়ুতে পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পিএম-২.৫ এর উপস্থিতি প্রতি ঘনমিটারে ৭৭ দশমিক ১ শতাংশ ছিল।
এই সংস্থার ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বায়ুতে এই কণার উপস্থিতি ছিল আরও বেশি। বছরজুড়ে গড়ে তা ছিল ৮৩ দশমিক ৩০। আর ২০১৮ সালে ছিল ৯৭ দশমিক ১০।
বায়ু দূষণে শীর্ষ রাজধানী হিসেবে টানা তৃতীয়বার উঠে এসেছে ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লি। দূষিত রাজধানীর তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ঢাকা। রাজধানী বায়ুতে দূষিত কণার উপস্থিতির পরিমাণ প্রতি ঘনমিটারে ৭৭ দশমিক ১। তবে বাংলাদেশের সবচেয়ে দূষিত শহর হিসেবে তালিকায় উঠে এসেছে মানিকগঞ্জ।
দূষিত রাজধানীর তালিকায় তৃতীয় মঙ্গোলিয়ার উলানবাটরের প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে পিএম-২.৫ এর উপস্থিতি পাওয়া গেছে ৪৬ দশমিক ৬ শতাংশ।
আইকিউএয়ার জানিয়েছে, গত বছর সামগ্রিক বায়ু মান বিবেচনায় বাংলাদেশের বায়ুতে প্রাণঘাতী পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পিএম-২.৫ এর উপস্থিতি প্রতি ঘনমিটারে ছিল ৭৭ দশমিক ১ শতাংশ; যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেওয়া সীমার চেয়ে সাতগুন বেশি। দূষিত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের পরে রয়েছে যথাক্রমে-পাকিস্তান, ভারত, মঙ্গোলিয়া ও আফগানিস্তান।
২০২০ সালের বিশ্বের শীর্ষ ৫০টি দূষিত শহরের তালিকায় ভারতেরই ৩৫টি শহর ঠাঁই পেয়েছে। মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক পিএম২.৫ বিভিন্ন ধরনের রোগ যেমন- ক্যান্সার, হৃদযন্ত্রের সমস্যা তৈরি করে। বায়ূতে পিএম-২.৫’র যে উপস্থিতি পেয়েছে তা বৈশ্বিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক বলে সতর্ক করেছে আইকিউএয়ার।
তবে বিশ্বের সবচেয়ে কম দূষিত শহর নির্বাচিত হয়েছে পুয়ের্তো রিকো, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ফরাসি ভুখণ্ড নিউ ক্যালেডোনিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার-এর গতবারের প্রতিবেদনেও বায়ুদূষণে বাংলাদেশ শীর্ষে ছিল, দূষিত রাজধানীতে ঢাকাও ছিল দ্বিতীয়তে। ২০১৯ সালে বিশ্বের ৯৮টি দেশের সার্বক্ষণিক বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছিল। বাংলাদেশের পর শীর্ষ তালিকায় থাকা অন্য দেশগুলো হলো পাকিস্তান, মঙ্গোলিয়া, আফগানিস্তান, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, বাহরাইন, নেপাল, উজবেকিস্তান ও ইরাক।
গতবার বাংলাদেশে বাতাসের প্রতি ঘনমিটারে পিএম ২.৫ এর মাত্রা ছিল ৮৩.৩। এর আগের বছর যা ছিল ৯৭.১। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান অনুযায়ী প্রতি ঘনমিটারে যা থাকার কথা ১০-এর কম। বাতাসে ক্ষুদ্র বস্তুকণা পিএম ২.৫-এর উপস্থিতি বিবেচনায় ৮৩ দশমিক ৩ স্কোর নিয়ে দূষিত রাজধানীর তালিকায় ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয় ছিল। এক্ষেত্রে শীর্ষে থাকা ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির স্কোর ৯৮ দশমিক ৩ ছিল।
বাংলাদেশ মূলত ২০১৮ সাল থেকে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশের তালিকায় শীর্ষে উঠে আসে। গত কয়েক বছরে একাধিকবার বায়ুদূষণ রোধে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোকে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত। দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থা পরিবেশ অধিদপ্তর বায়ুদূষণ রোধে বেশ কিছু উদ্যোগও নেয়।
২০১৫ সাল থেকে সংস্থাটি সারাবিশ্বের বায়ুর রিয়েল টাইম মান নির্ধারণের সেবা দিয়ে আসছে। বিশ্বের ৯০% মানুষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মানসম্মত সীমার নিচে অর্থাৎ দূষিত বায়ু গ্রহণ করে থাকলেও এ সম্পর্কে মানুষের কাছে তেমন কোন তথ্য নেই বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়।
বর্তমান বিশ্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি নিরাপদ বায়ুর নিশ্চয়তা। বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৭০ লাখ মানুষ এর প্রভাবে মৃত্যুবরণ করে থাকে। কম উন্নত দেশগুলোতে পাঁচ বছরের কম বয়সি ৯৮% শিশু দূষিত বায়ুর মধ্যে বেড়ে ওঠে। ফলে বিশ্বে শিশু মৃত্যুর প্রধান কারণ এখন বায়ুদূষণ। এর প্রভাবে প্রতি বছর ৬ লাখ শিশু মারা যায় বলে জানায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, দেশে বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর প্রাণ হারাচ্ছে ১ লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষ। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের ২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বায়ুদূষণজনিত বার্ষিক মৃতের গড় সংখ্যা ৪৬ হাজার। অন্যদিকে জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) তথ্য বলছে, বিশ্বে ৩০ কোটি শিশু দূষিত বায়ু পরিবেষ্টিত এলাকায় বাস করে। এর মধ্যে ২২ কোটিই দক্ষিণ এশিয়ার বাসিন্দা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নগরবাসীর কাছে যানজটের পাশাপাশি আরেক যন্ত্রণার নাম বায়ুদূষণ। মাত্রাতিরিক্ত দূষণের কবলে নগরজীবন বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছে। বাড়িয়ে তুলছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে শিশু, বৃদ্ধ ও শ্বাসতন্ত্রের রোগীরা।
প্রতিনিয়ত বায়ুদূষণে ফুসফুসের অক্সিজেন গ্রহণক্ষমতা কমে শ্বাসকষ্ট ক্রমাগত বাড়ে বলে জানান সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, প্রথমে শ্বাসনালি ও চোখে সমস্যা তৈরি করে। ফলে অ্যাজমা ও নিউমোনিয়ার রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে বলে উল্লেখ করেন। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদে এ দূষিত বায়ু গ্রহণ ব্রঙ্কাইটিস থেকে ফুসফুস ক্যান্সারের কারণ হতে পারে বলে উল্লেখ করেন। এদিকে বায়ুদূষণের কারণে ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি) বেশি দেখা দেয় বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
দূষণের মাত্রা দিন দিন বেড়ে চললেও কর্তৃপক্ষ কার্যত কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না এমন অভিযোগ রয়েছে পরিবেশবিদদের। ঢাকার উন্নয়ন প্রকল্পকে ঘিরে সকাল-বিকাল পানি ছিটানো হলেও আশানুরূপ ফল দৃশ্যমান নয়। এ অবস্থায় সিটি করপোরেশনের পানি ছিটানোর কাজে সার্বক্ষণিক তদারক এবং বাতাসের মান স্বাভাবিক ও জীবনযাত্রায় স্বস্তি ফেরাতে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। দূষণের মাত্রা যেভাবে বেড়েছে তা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গাড়ির কালো ধোঁয়া কমানো ও অপরিকল্পিত নির্মাণকাজের লাগাম টেনে ধরা প্রয়োজন বলে মনে করেন অনেকে।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, পরিবেশ রক্ষা করতে হলে মোটাদাগে যানবাহন, নির্মাণ শিল্প ও কল-কারাখানার দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এর মধ্যে বায়ুদূষণকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করতে হবে। সামগ্রিকভাবে সারা দেশকে দূষণের জন্য বিবেচনা করা হলেও রাজধানীর দূষণ এ সূচককে বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে মনে করেন তারা। বর্তমান সময়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের দূষণকে নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে রাখার পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আলোকে ঢাকাসহ সারা দেশের বায়ুমান নিয়ন্ত্রণ করার পরামর্শ দেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫০৯
আপনার মতামত জানানঃ