ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া তেত্রিশ সেকেন্ডের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ছোট্ট একটি শিশুকে লম্বা সাদা আলখাল্লা পরা এক ব্যক্তি ঘাড়ের কাছের কাপড় ধরে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যাচ্ছেন। কয়েক পা যাওয়ার পর শিশুটিকে একটি ঘরে ঢোকানো হয়। এরপর শিশুটিকে মাটিতে ফেলে বেত দিয়ে পেটাতে শুরু করেন ওই ব্যক্তি। শুরুতে শিশুটির ডান হাত ধরে পেটানো হয়। এক পর্যায়ে শিশুটি মাটিতে শুয়ে পড়ে। তখন তার ডান পা টেনে ধরে পায়ের ওপর পেটাতে থাকে ওই শিক্ষক।
চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিন বলেছেন, ভিডিওটি দেখেই শিশুটিকে এবং অভিযুক্ত শিক্ষককে শনাক্ত করা হয়েছে এবং ভিডিওটি যে মঙ্গলবারই ধারণ করা হয়েছে সে ব্যাপারেও তিনি নিশ্চিত হয়েছেন।
মঙ্গলবার রাতেই রুহুল আমিন ওই শিশুটিকে মাদ্রাসা থেকে নিয়ে আসেন, আটক করা হয় নির্যাতনকারী শিক্ষককেও, কিন্তু শিশুটির মা-বাবা আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ করতে রাজি না হওয়ায় প্রশাসন পরে ওই শিক্ষককে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
হাটহাজারির পুলিশ বলছে, পরে ছেলেটির মা একটি মামলা দায়ের করলে ওই শিক্ষককে তারা গ্রেফতার করেছেন
মাদ্রাসা শিক্ষক গ্রেফতার
মো. ইয়াসিন ফরহাদ (৭) নামে ওই মাদ্রাসা ছাত্রকে বেধড়ক মারধরের ঘটনায় থানায় দায়েরকৃত ওই মামলায় অভিযুক্ত শিক্ষক হাফেজ ইয়াহিয়াকে গ্রেফতার করেছে হাটহাজারী থানা পুলিশ।
মারধরের ঘটনায় অভিযুক্ত শিক্ষককে বিকেলে হাটহাজারী পৌরসভার কামাল পাড়া পশু হাসপাতালের পাশ থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাটহাজারী থানার পরিদর্শক (অপারেশন) মো. তৌহিদ। গ্রেফতার হাফেজ ইয়াহিয়া রাঙ্গুনিয়া উপজেলার সাফরভাটা গ্রামের মোহাম্মদ ইউনুসের ছেলে।
হাটহাজারী থানার ডিউটি অফিসার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. হারুনুর রশিদ জানান, বুধবার (১০ মার্চ) বিকেলে শিশু শিক্ষার্থীকে মারধরের ঘটনায় তার বাবা মোহাম্মদ জয়নাল বাদী হয়ে মারকাজুল কোরআন ইসলামি অ্যাকাডেমি মাদ্রাসার হিফজ বিভাগের শিক্ষক হাফেজ ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।
মাদ্রাসা শিক্ষককে সাজা দিতে চাননি শিশুটির বাবা-মা
মঙ্গলবার রাতে ভাইরাল ভিডিওটি দেখে রুহুল আমিন রাত একটার দিকে পুলিশ নিয়ে হাটহাজারীর মারকাযুল কুরআন ইসলামিক একাডেমী নামে ওই মাদ্রাসায় যান। সেখান থেকে নির্যাতনের শিকার শিশু, অভিযুক্ত শিক্ষক এবং মাদ্রাসার পরিচালককে নিয়ে উপজেলা প্রশাসন কার্যালয়ে নিয়ে আসেন।
এর পর শিশুটির মা-বাবাকে ডেকে আনা হয়। মা-বাবাকে ভিডিওটি দেখানোর পর মা কান্নায় ভেঙে পড়েন। কিন্তু তারা ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক কোন অভিযোগ দিতে চাননি, তাকে কোন সাজা দিতে চাননি।
এ প্রসঙ্গে রুহুল আমিন বলেন, মামলা দায়ের করার জন্য তিন ঘণ্টার বেশি সময় ধরে শিশুটির মা-বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি আমরা। এমনকি আজ সকালেও শিশুটির বাড়িতে গিয়েছিলাম আমি, তখনও তাদের বলেছি, কিন্তু তারা কিছুতেই মামলা করবে না শিক্ষকের বিরুদ্ধে।
শিশুটির মা-বাবা মামলা করতে রাজি তো হননি, বরং নির্যাতনের শিকার শিশুর মা-বাবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বরাবরে একটি চিঠি দিয়েছেন রাতেই, যেখানে অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নিতে আবেদন জানানো হয়েছে। ফলে রাত সাড়ে চারটায় ওই শিক্ষকের কাছ থেকে মুচলেকা নিয়ে শিশুটির মা-বাবার জিম্মায় তাকে ছেড়ে দেয় প্রশাসন।
কিন্তু বুধবার রাতে স্থানীয় পুলিশ জানিয়েছে যে শিশুটির মা থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন এবং তারপর ওই শিক্ষককে গ্রেফতার করা হয়েছে।
কিন্তু শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে না চাওয়ার কারণ হিসেবে শিশুটির বাবা মোহাম্মদ জয়নাল বলেন, ছেলেকে হাফেজী পড়াইতে চাই আমরা, সে তো ওইখানে পড়বে, তাইলে মামলা করে কী হবে? উল্টা শিক্ষকের জীবনটা নষ্ট হবে।
আইন কী আছে?
বাংলাদেশের আইনে ছাত্রদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দেয়া দণ্ডনীয় অপরাধ৷ ২০১১ সালে হাইকোর্টের এক আদেশের পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি বন্ধে নীতিমালা প্রণয়ন করে৷ আর তাতে শারীরিক ও মানসিক শাস্তির সংজ্ঞাও দেয়া হয়েছে৷ শারীরিক শাস্তি বলতে যেকোনো ধরনের দৈহিক আঘাত বলা হয়েছে৷ মারধর ছাড়াও আইনে কান ধরা, চুল টানা, বেঞ্চের নিচে মাথা রাখতে বাধ্য করাও দৈহিক শাস্তি৷ আর মানসিক শাস্তির মধ্যে শিশু বা তার পরিবারকে উদ্দেশ্য করে বাজে মন্তব্য বা যেকেনো আপত্তিকর অঙ্গভঙ্গি৷
শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই দুই ধরনের শাস্তি দেয়াকেই শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলেছে৷ যাদের বিরুদ্ধে এই অপরাধ প্রমাণ হবে তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে৷ একই সঙ্গে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও বলা হয়েছে৷
কিন্তু এরপরও বাংলাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শাস্তি দেয়ার প্রবণতা বেশ লক্ষ্য করা যায়৷ বিশেষ করে মাদ্রাসায় এটা প্রকট৷
শিক্ষকের বিরুদ্ধে গৃহীত পদক্ষেপের বিষয়ে জানতে চেয়েছে হাইকোর্ট
ভুক্তভোগী এই শিক্ষার্থীক নির্যাতনের ঘটনায় গৃহীত পদক্ষেপে বিষয়ে জানাতে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। সংশ্লিষ্ট ডিসি, এসপি ও ওসিকে রবিবারের (১৪ মার্চ) মধ্যে এ বিষয়ে তথ্য দিতে বলা হয়েছে।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা ঘটনাটি নজরে আনলে বৃহস্পতিবার (১১ মার্চ) বিচারপতি এফআরএম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি শাহেদ নুরুউদ্দীনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। এসময় আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারের এবিএম আব্দুল্লাহ আল মাহমিদ বাশার।
হাইকোর্ট তার আদেশে অভিযুক্ত মাদ্রাসা শিক্ষকের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, গ্রেফতার ও মাদ্রাসা থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে কিনা এবং ফৌজদারি আইনে মামলা হয়েছে কিনা- এসব বিষয়ে জানাতে নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি নির্যাতনের শিকার শিশুকে চিকিৎসা ও নিরাপত্তা দিতে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা জানাতেও বলা হয়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯৫০
আপনার মতামত জানানঃ