নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বসুরহাটে আওয়ামী লীগের দু’পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনায় এলাকাটিতে এখন থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জা ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বাদলের সমর্থকদের মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত দফায় দফায় সংঘর্ষ ও মুহুর্মুহু গুলিতে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে পুরো বসুরহাট বাজার। বাদলের সমর্থকদের গুলিতে নিহত হন কাদের মির্জার অনুসারী আলাউদ্দিন।
সংঘর্ষ ও বিস্ফোরণের পর গুলিতে একজন নিহতের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এবং ফের সংঘর্ষের আশঙ্কায় প্রশসান বসুরহাট পৌরসভা এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে।আজ বুধবার(১০ মার্চ) সকাল ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত এই ১৪৪ ধারা কার্যকর থাকবে বলে জনিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জিয়াউল হক মীর।
তিনি বলেন, উপজেলা আ.লীগের দু’পক্ষের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচী ও সংঘর্ষের ঘটনায় আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার আশংকায় ১০ মার্চ বুধবার ভোর ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত বসুরহাট পৌর এলাকায় ১৪৪ধারা জারি করা হয়েছে। এ আদেশ চলাকালে পৌর এলাকায় ব্যক্তি, সংগঠন, রাজনৈতিক দল, গণজমায়েত, সভা, সমাবেশ, মিছিল, র্যালি, শোভাযাত্রা, যে কোন ধরনের অনুষ্ঠান এবং রাজনৈতিক প্রচার প্রচারণা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একইসঙ্গে পৌর শহরে ৪জনের বেশি লোক জমায়েত হতে পারবে না।
এর আগেও গত ২২ ফেব্রুয়ারি দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বের জেরে বসুরহাট পৌর এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল।
গত সোমবার পাল্টাপাল্টি হামলার পর গতকালও সংঘর্ষে জড়ায় বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমানের অনুসারীরা। এ সময় গুলি ও ককটেল বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। দুই দফার সংঘর্ষে পুলিশসহ অর্ধশত লোক আহত হয়েছেন। নিহত হয়েছেন আলাউদ্দিন (৩২) নামের এক ব্যক্তি। তিনি উপজেলার চরফকিরা ইউনিয়নের চরকালী গ্রামের মমিনুল হকের ছেলে। তাকে নিজের অনুসারী বলে দাবি করেছেন মিজানুর রহমান।
গতকাল প্রথম সংঘর্ষের ঘটনাটি ঘটে বিকেলে বসুরহাট পৌরসভার রূপালী চত্বর এলাকায়। রূপালী চত্বরে ওই সময় কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি খিজির হায়াত খানের ওপর হামলার প্রতিবাদে সভা চলছিল। ককটেল বিস্ফোরণ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ায় সভাটি পণ্ড হয়ে যায়। এ সময় আহত হন ২০ জনের মতো।
আবদুল কাদের মির্জার অনুসারীরা সভায় হামলা চালিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন মিজানুর রহমান। ওই সংঘর্ষের জেরে রাত সাড়ে নয়টার দিকে বসুরহাট বঙ্গবন্ধু চত্বর ও পৌর ভবন এলাকায় আবারও সংঘর্ষে জড়ায় দুই পক্ষ। স্থানীয় সূত্র জানায়, প্রায় ২০ মিনিট ধরে দুই পক্ষের এই গোলাগুলি চলে। এ সময় উভয় পক্ষের কমপক্ষে আরও ৩০ জন আহত হন।
এই দুই পক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে সাংবাদিক বুরহান উদ্দিন মুজাক্কিরের মৃত্যুর তিন সপ্তাহ না যেতেই মঙ্গলবার এই ঘটনা ঘটল। সংঘর্ষে নিহত ব্যক্তির নাম আলাউদ্দিন (৩২)। তিনি উপজেলার চর ফকিরা ইউনিয়নের চর কালি গ্রামের মমিনুল হকের ছেলে।
স্থানীয় সূত্র বলছে, আলাউদ্দিনকে নিজের অনুসারী বলে দাবি করেছেন মিজানুর রহমান ওরফে বাদল। গুরুতর আহত জাকির হোসেন ওরফে হৃদয়সহ (২৫) উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জাকিরসহ তিনজনকে ঢাকায় নেওয়া হয়েছে। অন্যদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ দুই গ্রুপের মধ্যে দ্বিতীয় দফায় তীব্র সংঘর্ষ ১ জন নিহত ও কমপক্ষে ১০ জন গুলিবিদ্ধসহ ৩০ জন আহত হয়। ওই ঘটনার জের ধরে নতুন করে যাতে সহিংসতা ঘটতে না পারে সেজন্য ১৪৪ ধারা জারির সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন।
মঙ্গলবারের সংঘর্ষে একজন নিহতের ঘটনায় রাতেই ২৭ জনকে আটক করেছে পুলিশ। তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন নোয়াখালীর পুলিশ সুপার মো. আলমগীর হোসেন।
নোয়াখালীর পুলিশ সুপার মো. আলমগীর হোসেন বলেন, পুলিশের উপর হামলার ঘটনায় ও রাতে সংঘর্ষের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে ২৭ জনকে আটক করা হয়েছে। তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে।
তিনি বলেন, সংঘর্ষের ঘটনায় কোনো পক্ষই বুধবার বেলা ১১টা পর্যন্ত লিখিত কোনো অভিযোগ দেয়নি। অভিযোগ পেলে পুলিশ আইনি ব্যবস্থা নেবে। পুলিশ, ডিবি ও র্যাব সদস্যরা রাস্তায় টহল দিচ্ছে। পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
এর আগে, গত ১৯ ফেব্রুয়ারি কোম্পানীগঞ্জের চাপরাশিরহাট পূর্ব বাজারে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই বসুরহাট পৌর মেয়র আবদুল কাদের মির্জা এবং সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান বাদলের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। সেসময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ বেশ কয়েক রাউন্ড টিয়ারসেল ও শর্টগানের গুলি ছুঁড়ে। ঘটনার ছবি ও ভিডিও ধারণ করতে গিয়ে ত্রিমুখী সংঘর্ষের মুখে পড়ে গুলিবিদ্ধ হন সাংবাদিক মুজাক্কিরসহ ৭-৮ জন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টা ৪৫মিনিটে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান মুজাক্কির।
এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে আবদুল কাদের মির্জা ও মিজানুর রহমান বাদল একই স্থানে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ঘোষণা করেন। পরে আইন-শৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কায় গত ২২ ফেব্রুয়ারি সোমবার বসুরহাটে ১৪৪ ধারা জারি করেছিল প্রশাসন।এ ঘটনার ১৫ দিন পর আলাউদ্দিন নামের আরেক যুবক গুলিতে মারা গেল।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগে বিরোধী দলের সাথে আদিপত্য বিস্তার নিয়ে সরকারি দলের এমন চিত্র দেখা যেত। এখন দেশে কোনো বিরোধী দল নেই। মাঠে সরকারি বিরোধী এখন আওয়ামী লীগ সরকারই। বিরোধী দল না থাকায় স্বাভাবিকভাবে দলটিতে বিভক্তির তৈরী হবে আর এমন সংঘর্ষে আধিপত্যে বিস্তারে নিজেদের ক্ষমতা জানান দেবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই বসুরহাটে উত্তপ্ত। সংঘর্ষ গোলাগুলিতে আহত নিহতও হয়েছে অনেক। আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের মাঝে এই সংঘর্ষ গোলাগুলি চললেও দলটির কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে এখনো লক্ষ্যণীয় কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। প্রশাসনও আছে সংশয় ও বিব্রতকর অবস্থাতে। দুদলই সরকারী দলের হওয়াতে কোনো পক্ষের বিরুদ্ধে যেতে পারছে না, আর সংঘর্ষও চলছে কদিন পরপর।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩২৩
আপনার মতামত জানানঃ