তেহরানে সম্ভাব্য সামরিক হামলার জন্য তেলআবিব পরিকল্পনা করছে বলে ইসরাইলের যুদ্ধমন্ত্রী বেনি গান্তজ সম্প্রতি মন্তব্য করেন। তার জবাবে রোববার(০৭ মার্চ) ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমির হাতামি ইরানের পরমাণু স্থাপনায় ইসরাইল হামলার ধৃষ্টতা দেখালে তেলআবিব ও হাইফা গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে বলে হুশিয়ার করেছেন।
ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, ইহুদিবাদী শাষকগোষ্ঠী ভালো করেই জানে এবং তারা যদি না জেনে থাকে, তা হলে তাদের অবশ্যই জেনে রাখা উচিত যে, মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া দখলদার ইসরাইলের শাসকগোষ্ঠী সামান্য বাড়াবাড়ি করলে তেলআবিব ও হাইফা শহর গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে।
জেনারেল হাতামির বক্তব্য
ইরান তার পরমাণু কর্মসূচি বাড়াবাড়ি পর্যায়ে নিয়ে গেলে ইসরাইল তাতে হামলা চালাবে বলে বেনি গান্তজ হুমকি দেওয়ার পর জেনারেল হাতামি ইসরাইলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, মাঝে মাঝে তারা ছোটমুখে অনেক বড় বড় কথা বলে ফেলেন। এসব হুমকি-ধামকির মাধ্যমে এটি স্পষ্ট যে, তারা চরম হতাশাগ্রস্ত।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি অনেক বছর আগে ইহুদিবাদীদের সমুচিত জবাব দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ইহুদিবাদী ইসরাইল আমাদের প্রধান শত্রু নয়; এমনকি ইরানের সঙ্গে শত্রুতা বজায় রাখার ন্যূনতম যোগ্যতাও তাদের নেই।
ইরানের সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়কের আদেশ অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে কার্যকর করা হয়েছে এবং এটি একটি নীলনকশায় রূপান্তরিত হয়েছে। সর্বোচ্চ নেতার সামান্য ইঙ্গিতেই তা বাস্তবায়ন করা হবে। তাই আমি তাদের উপদেশ দেব, তারা যেন কখনই এ ভুল না করে।
জেনারেল রাশিদের হুঁশিয়ারি
ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) খাতামুল আম্বিয়া সেন্ট্রাল হেড কোয়ার্টার্সের কমান্ডার মেজর জেনারেল গোলাম আলী রাশিদ সম্প্রতি জানান, ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধ বাধানোর পাঁয়তারা করছে।
তেহরানে সেনা কর্মকর্তাদের এক সমাবেশে জেনারেল রাশিদ বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন, ‘ইরানকে একটি সর্বাত্মক সংঘাতে আমন্ত্রণ জানানো এবং আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা বিপন্ন করার হুমকি দিয়ে মূলত ইহুদিবাদী ইসরায়েল কৌশলগত ভুল হিসাব নিকাশ করছে।’
তিনি বলেন, তেল আবিব যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানের বিরুদ্ধে সেরকম একটি সংঘাতে যেতে উসকানি দিয়ে মূলত মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থিতিশীল করার পাশাপাশি মার্কিন সেনাদের প্রাণহানির পথ সুগম করছে।
ইরানে হামলার ছক কষছে ইসরায়েল
ফেব্রুয়ারিতে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ইরানে সম্ভাব্য হামলার প্রস্তুতি নিয়ে দেশটির জ্যেষ্ঠ নিরাপত্তা ও সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। এর মাত্র দু’দিন পরেই বুধবার ইরান ইস্যুতে আলোচনায় অগ্রগতির জন্য মন্ত্রিসভার বৈঠক আহ্বান করেছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী।
ইসরায়েলি কান নিউজ চ্যানেল জানিয়েছে, দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেনি গান্টজ, চিফ অব স্টাফ আবিব কোচাবিসহ ইসরায়েলের অর্থ ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। তারা ইরানের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য অভিযান পরিচালনার জন্য অর্থ সরবরাহের বিষয়ে আলোচনা করেছেন।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, ইসরায়েলি মন্ত্রীদের এই বৈঠকে ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ, ইরান পরমাণু অস্ত্রের উপরকরণ জোগাড় থেকে কয়েক সপ্তাহ দূরে বলে যুক্তরাষ্ট্রের সতর্কতা, ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু চুক্তিতে ফেরা, ভারতে ইসরায়েলি দূতাবাসের পাশে বোমা হামলাসহ ইরানের বিভিন্ন ‘প্রতিশোধমূলক প্রচেষ্টা’র বিষয়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে।
এমনকি ইসরায়েলি চিফ অব স্টাফ ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি দেশটির সেনাবাহিনীকে ইরানের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য হামলার প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
ইরানে হামলার ক্ষমতা ইসরায়েলের নেই
ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক হামলার পরিকল্পনা যাচাই করা হচ্ছে বলে দেওয়া ইসরায়েলের হুমকিকে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ বলে আখ্যা দিয়েছে তেহরান। ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির চিফ অব স্টাফ বলেছেন, কার্যত তাদের (ইসরায়েলের) সেই পরিকল্পনা নেই, আবার তা বাস্তবায়নের ক্ষমতাও নেই।
মাহমুদ ভায়েজি বলেন, পূর্ববর্তী ট্রাম্প প্রশাসনের মতো বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাইডেনের প্রশাসন ইসরায়েলের কমান্ড মেনে চলবে না। জায়নবাদী রাষ্ট্রের কিছু কর্মকর্তা মনে করছেন তারা যা বলবে ওয়াশিংটন তা-ই মেনে নেবে। কিন্তু বিশ্বাস করুন নতুন মার্কিন প্রশাসনের নিজস্ব স্বাধীনতা আছে, যেমনটা অন্য দেশগুলোরও আছে।
ইরানের কর্মকর্তা ভায়েজি বলেন, জানুয়ারিতে তার দেশ ক্ষেপণাস্ত্র, সাবমেরিন এবং ড্রোনের পরীক্ষা চালিয়েছে। এগুলোর মধ্য দিয়ে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে আমরা যুদ্ধ চাই না, কিন্তু নিজেদের দেশ রক্ষায় আমরা খুবই হুঁশিয়ার।
উল্লেখ্য, ইসরায়েল ছাড়াও এ অঞ্চলের সৌদি আরবের মতো কিছু দেশ ইরানের বিরুদ্ধে ওয়াশিংটনে লবিং করার চেষ্টা করছে।
ইরান নিয়ে বাইডেনের অবস্থানে দুশ্চিন্তায় ইসরায়েল
ইরান এবং ফিলিস্তিন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চিন্তায় পড়ছে ইসরায়েল। ক্ষমতা গ্রহণের ২৪ ঘণ্টা যেতে না যেতেই বাইডেন প্রশাসন ঘোষণা দিয়েছিল, তারা ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি পুনর্বহাল এবং ইসরায়েল-ফিলিস্তিন পৃথক রাষ্ট্র গঠনে উদ্যোগী হচ্ছে। এ নিয়েই শঙ্কায় পড়েছেন ইসরায়েলি কর্মকর্তারা।
ওয়ালার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বাইডেনকে ইরানের সঙ্গে চুক্তিতে না ফিরতে এবং তাদের সঙ্গে আগাম পরামর্শ করতে অনুরোধ জানাচ্ছিল ইসরায়েল ও উপসাগরীয় দেশগুলো। মার্কিন কংগ্রেসের এক শুনানিতে মনোনীত পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ইরানি ফাইলের বিষয়ে শুধু রিপাবলিকানদেরই নয়, বরং এই দেশগুলোকেও আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছেন।
ইসরায়েলি পত্রিকাটি জানিয়েছে, ব্লিঙ্কেন মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্টের মিত্রদের এই বলে আশ্বস্ত করেছেন যে, পরমাণু চুক্তিতে ফেরা একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া এবং সেটি হলে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করেই হবে।
দৈনিক ওয়ালার তথ্যমতে, বাইডেন প্রশাসনের শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তাকে নিয়েও চিন্তায় পড়েছেন নেতানিয়াহু।
তাদের মধ্যে আছেন ইরানে বিশেষ দূত হতে চলা রবার্ট ম্যালে, উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়েন্ডি শারম্যান, সিআইএ’র সম্ভাব্য পরিচালক এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভান প্রমুখ।
এসব কর্মকর্তা বিভিন্নভাবে ইরানের সঙ্গে ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তিতে ভূমিকা রেখেছিলেন। সেসময় ওই চুক্তির তীব্র বিরোধিতা করেছিল ইসরায়েল এবং উপসাগরীয় কয়েকটি দেশ।
২০১৮ সালে সেই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাম প্রত্যাহার করে নেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এটিকে ‘ঐতিহাসিক ঘটনা’ হিসেবে উল্লেখ করে ইসরায়েল।
ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া
তেহরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু চুক্তিতে ফিরলে সেটি মস্ত বড় ভুল হবে বলেও সতর্ক করেছেন ইসরায়েলি লেফটেন্যান্ট জেনারেল আবিব কোহাবি। মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে ইসরায়েলের এ ধরনের মন্তব্য খুবই বিরল। এটি নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জন্য মধ্যপ্রাচ্যনীতি নিয়ে ইসরায়েলের একটি সতর্কবার্তা বলে মনে করছেন অনেকে।
তেল আবিব ইউনিভার্সিটির একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্যকালে জেনারেল আবিব কোহাবি বলেন, ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তিতে ফেরা অথবা কিছুটা পরিমার্জন করে একই ধরনের চুক্তি হওয়া কৌশলগত দিক থেকে খারাপ এবং ভুল।
২০১৮ সালে বাইডেনের পূর্বসূরী ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে হওয়া ওই চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেন। যুক্তরাষ্ট্রের এ পদক্ষেপকে সেসময় স্বাগত জানিয়েছিল পুরনো মিত্র ইসরায়েল। তবে ইরান ইস্যুতে নতুন মার্কিন প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গিতে চিন্তিত হয়ে উঠেছে দেশটি।
অবশ্য বাইডেন প্রশাসনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন মঙ্গলবারও মার্কিন মিত্রদের আশ্বস্ত করেছেন, ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তিতে ফেরা থেকে এখনও অনেক দূরে যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি আগে কী ব্যবস্থা নেয় তা দেখতে চায় ওয়াশিংটন।
যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার পর ধারাবাহিকভাবে ইউরেনিয়ামের মজুত বাড়িয়েছে ইরান। সেন্ট্রিফিউজ বসিয়েছে। এগুলো চুক্তিবিরোধী হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
কোহাবির দাবি, ইরানের কর্মকাণ্ড দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, তারা দ্রুত পারমাণবিক বোমা তৈরির দিকে এগোচ্ছে। যদিও এধরনের অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করেছে তেহরান।
ইসরায়েলের এ সেনা কর্মকর্তা বলেন, মৌলিক বিশ্লেষণের আলোকে আমি ইতোমধ্যে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীকে বিদ্যমানগুলোর পাশাপাশি আরও কয়েকটি অভিযান পরিকল্পনা প্রস্তুতের নির্দেশ দিয়েছি। সেগুলো প্রয়োগের সিদ্ধান্ত অবশ্যই রাজনৈতিক নেতাদের হাতে, তবে পরিকল্পনাগুলো টেবিলে থাকা দরকার।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েল-মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্কে বড় বিষয় ইরান। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের ক্রমবর্ধমান প্রভাব আর শক্তি মোকাবেলায় ইসরায়েলের সাথে সম্পর্কে জড়াচ্ছে মুসলিম অনেক দেশ। এদিকে, ট্রাম্পের সাথে ইসরায়েলের সম্পর্ক থেকে কিছুটা ভিন্নভাবেই নতুন সম্পর্কের দিকে ঝুঁকছেন বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্যনীতি। যেটা ইসরায়েলের জন্য পূর্বের ন্যায় সুবিধাজনক হবে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে। তাই মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নির্ভর করছে সামনের দিনগুলোতে ইরান-ইসরায়েলের গৃহীত পদক্ষেপের উপর।
এসডব্লিউ/এসএস/কেএইচ/১৮৩০
আপনার মতামত জানানঃ