ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের অব্যাহতিপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন বরকত ও তার ভাই ইমতিয়াজ হাসান রুবেলের অবৈধ উপায়ে অর্জিত বিপুল পরিমাণ স্থাবর/অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। দুই ভাইয়ের ৪৮৭টি তফসিলে পাঁচ হাজার ৭০৬ বিঘা সম্পত্তি, একইসঙ্গে ১৮৮ ব্যাংক হিসাবের পৌনে ১০ কোটি টাকা এবং বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকারসহ ৫৫টি গাড়ি জব্দের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সিআইডির করা এক আবেদনের প্রেক্ষিতে দুই হাজার কোটি টাকা পাচারের মামলায় আজ বৃহস্পতিবার(২৫ ফেব্রুইয়ারি) সকালে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েশের আদালত এ আদেশ দেন। অতিরিক্ত পিপি তাপস কুমার পাল এ তথ্য সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেন।
পিপি তাপস কুমার পাল বলেন, অর্থ পাচার মামলায় সাজ্জাদ হোসেন বরকত, তার ভাই ইমতিয়াজ হাসান রুবেলসহ পাঁচজনের ৮৮টি ব্যাংক হিসাব আজ ক্রোক করার আদেশ দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে তাদের ১৮৮টি ব্যাংক হিসাবে থাকা ৯ কোটি ৮৮ লাখ টাকা এবং তাদের মালিকানাধীন ৫৫টি বাস, ট্রাক ও ব্যক্তিগত গাড়ি ক্রোক করারও আদেশ দিয়েছেন আদালত।
বরকত ও রুবেলের বিরুদ্ধে সিআইডির পরিদর্শক এস এম মিরাজ আল মাহমুদ বাদী হয়ে গত বছরের ২৬ জুন ঢাকার কাফরুল থানায় অর্থ পাচারের অভিযোগে মামলা করেন। মামলায় ওই দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে দুই হাজার কোটি টাকার সম্পদ অবৈধ উপায়ে উপার্জন ও পাচারের অভিযোগ আনা হয়। ২০১২ সালের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন সংশোধনী-২০১৫-এর ৪ (২) ধারায় এ মামলা করা হয়।
মামলার এজাহারে বলা হয়, ২০১০ সাল থেকে এ বছর পর্যন্ত ফরিদপুরের এলজিইডি, বিআরটিএ, সড়ক বিভাগসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কাজের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করে বিপুল অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন বরকত ও রুবেল। এ ছাড়া, মাদক ব্যবসা ও ভূমি দখল করে অবৈধ সম্পদ গড়েছেন। ২৩টি বাস, ট্রাকসহ বিলাসবহুল গাড়িরও মালিক হয়েছেন। এছাড়া বিপুল পরিমাণ অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করেছেন।
জানা যায়, সাজ্জাদ হোসেন বরকত ফরিদপুর আওয়ামী লীগের অব্যাহতি পাওয়া সাধারণ সম্পাদক আর তার ভাই ইমতিয়াজ হাসান রুবেল ফরিদপুর প্রেসক্লাবের অব্যাহতি পাওয়া সভাপতি।
২০১৫ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েই ফরিদপুর শহর যুবলীগের সভাপতি হন বরকত। এছাড়া তিনি জেলা বাস মালিক গ্রুপের সভাপতিও হন। এরপর শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়ে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, দখলবাজি ও জালিয়াতিতে জড়িয়ে পড়েন। বরকাতের ভাই রুবেল সাংবাদিকতার কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই ফরিদপুর প্রেস ক্লাবের সভাপতি হন এবং একটি পত্রিকার ডিক্লারেশনও নেন। ওই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন রুবেল আর প্রকাশক বরকত। এছাড়া ফরিদপুরের বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনও তারা কব্জায় নিয়ে নানা দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হন।
বরকতের বিরুদ্ধে করা মামলার এজাহারে বলা হয়, ‘মো. সাজ্জাদ হোসেন বরকত কর্তৃক অবৈধ উপায়ে অর্জিত জ্ঞাত আয় বহির্ভূত অর্থের দ্বারা ৪৪ কোটি ৪৯ লাখ ৬৮ হাজার ৮৩২টাকা মূল্যের সম্পদের মালিকানা অর্জন করেন। তার দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে মোট ৩৬ কোটি ৪০ লাখ ৫৫ হাজার ৬৫২ টাকা মূল্যের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ গোপন করেছেন।
এজাহারে বলা হয়েছে, বরকত দুর্নীতি দমন কমিশনে দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে উক্ত জ্ঞাত আয় বহির্ভূত অর্জিত অর্থের উৎস ও খাতের মিথ্যা বিবরণী দাখিল করে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৬(২) ও ২৭(১) ধারা ও মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
ইমতিয়াজ হাসান রুবেলের বিরুদ্ধে করা মামলায় বলা হয়, ‘তিনি অবৈধ উপায়ে অর্জিত জ্ঞাত আয় বহির্ভূত অর্থের দ্বারা ২৮ কোটি ৩৫ লাখ ১০ হাজার ১৭০ টাকা মূল্যের সম্পদের মালিকানা অর্জন করেন। তিনি তার দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে মোট ১৭ কোটি ৯০ লাখ ৩ হাজার ১৪১ টাকা মূল্যের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ গোপন করেছেন।
এজাহারে বলা হয়েছে, রুবেল দুর্নীতি দমন কমিশনে দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে উক্ত জ্ঞাত আয় বহির্ভূত অর্জিত অর্থের উৎস ও খাতের মিথ্যা বিবরণী দাখিল করে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৬(২) ও ২৭(১) ধারা ও মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
দুদকে জমা হওয়া অভিযোগ অনুযায়ী, ফরিদপুরের রাজনৈতিক ক্ষমতাকে পুঁজি করে ২ হাজার কোটি টাকা আয় করেন বরকত ও রুবেল। রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় সন্ত্রাস, জমি দখল, টেন্ডারবাজিসহ নানা অপকর্ম করে বেড়াতেন তারা। বিভিন্ন সরকারি সংস্থায় প্রভাব খাটিয়ে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও জমি দখল করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন। যাকে খুশি তাকে মারধর ও লাঞ্ছিত করতেন এ দুই ভাই। তাদের আক্রোশের শিকার হয়ে অনেকে ফরিদপুর শহর থেকে পালিয়ে অন্যত্র চলে যান। ফরিদপুরের বাইরে খুলনা, গোপালগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, মাগুরা, পটুয়াখালী, শেরপুর, সিলেট, গাজীপুর ও দিনাজপুরেও ঠিকাদারি কাজের নিয়ন্ত্রণ ছিল তাদের। গ্রেপ্তারের পর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন তারা।
রাজবাড়ীতে ১৯৯৪ সালের ২০ নভেম্বর এক আইনজীবী খুন হন। সে হত্যা মামলার আসামি ছিলেন এ দুই ভাই।
গত ১৬ মে রাতে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবল চন্দ্র সাহার বাড়িতে দুই দফা হামলার ঘটনা ঘটে। সুবল সাহার বাড়ি শহরের গোয়ালচামট মহল্লার মোল্লা বাড়ি সড়কে। এ ঘটনায় গত ১৮ মে সুবল সাহা অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে ফরিদপুর কোতোয়ালী থানায় একটি মামলা করেন। গত বছরের ৭ জুন রাতে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবল চন্দ্র সাহার বাড়িতে হামলার মামলার আসামি হিসেবে শহরের বদরপুরসহ বিভিন্ন মহল্লায় অভিযান চালিয়ে পুলিশ সাজ্জাদ হোসেন, তার ভাই ইমতিয়াজ হাসানসহ ৯ জনকে গ্রেপ্তার করে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আওয়ামী লীগের পদ প্রাপ্তরা স্থানীয়ভাবে নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য তৈরী করেন যার ফলে বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে রাতারাতি বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক বনে যান। স্থানীয়ভাবে তাদের ক্ষমতা ও প্রভাব থাকে বিধায় প্রশাসনও কোনো পদক্ষেপ নিতে সাহস করে না, এমনকি তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার মতো সাহস রাখেন না কেউ। এসব দেশের সর্বত্রই রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, জবাবদিহিতার আওতায় না আনা গেলে রাষ্ট্র থেকে এসব দূর করা অসম্ভব হয়ে উঠবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০২০
আপনার মতামত জানানঃ