সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যার পেছনে নির্দেশদাতা হিসাবে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে দায়ি করা হতে পারে মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট অন্তত ৪ জন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে এ তথ্য জানিয়েছেন। সৌদি আরবের সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ড নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি গোপন গোয়েন্দা প্রতিবেদন আজ বৃহস্পতিবার প্রকাশ করা হতে পারে বলে ওই কর্মকর্তারা রয়টার্সকে জানিয়েছেন।
মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, খাসোগিকে হত্যার অনুমোদন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান দিয়েছেন বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে আসবে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গোয়েন্দা প্রতিবেদন অনুযায়ী সৌদি যুবরাজই খাসোগি হত্যার অনুমোদন দেন এবং হতে পারে তিনি সেটার নির্দেশও দেন।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনটি তৈরি করতে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে সিআইএ। গতকাল সিএনএন এক প্রতিবেদনে জানায়, খাসোগি হত্যা মিশনে ব্যবহৃত দুটি ব্যক্তিগত উড়োজাহাজের মালিক এমন একটা কোম্পানি, যেটি তখনকার সময় থেকে প্রায় এক বছর আগে জব্দ করেন সৌদির যুবরাজ।
২০১৮ সালের অক্টোবরে তুরস্কের ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে নির্মমভাবে খুন হন সাংবাদিক জামাল খাসোগি। তিনি সৌদির যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের কট্টর সমালোচক ছিলেন। শুরু থেকেই হত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে মোহাম্মদ বিন সালমানকে সন্দেহ করা হচ্ছে। অবশ্য যুবরাজ এই হত্যায় তার সরাসরি সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করে আসছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাদের তদন্তে তিনি অভিযুক্ত।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সাংবাদিকদের বলেছেন, তিনি ওই রিপোর্ট দেখেছেন। শিগগির তিনি এই বিষয় নিয়ে ৩৫ বছর বয়সী যুবরাজের বাবা সৌদি আরবের রাজা ৮৫ বছর বয়সী সালমানের সঙ্গে কথা বলবেন।
২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রচার চলাকালেই বাইডেন অভিযোগ করেছিলেন, সৌদির যুবরাজের নির্দেশেই খাসোগি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
পূর্বসূরি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে সৌদির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক যেমনটা ছিল, বাইডেনের সময় ঠিক তেমনটা থাকছে না। এই সম্পর্কে পরিবর্তন আনার কাজ ইতিমধ্যে শুরু করে দিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। গত ২০ জানুয়ারি বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন। প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দেশের নেতার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। তবে সৌদি নেতৃত্বের সঙ্গে এখনও কথা হয়নি তার।
সম্প্রতি হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি জেন সাকি সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে জানান, রাষ্ট্রীয় প্রটোকলে সৌদি আরবে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সমমর্যাদার ব্যক্তি দেশটির বাদশাহ সালমান। তার সঙ্গে যথাসময়ে বাইডেনের কথা হবে। তবে সৌদির যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে ফোন করার কোনও পরিকল্পনা বাইডেনের নেই।
সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠন নীতির অংশ হিসেবে বাইডেন প্রশাসন খাসোগি হত্যাকাণ্ড নিয়ে এই গোপন মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করতে যাচ্ছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও ইয়েমেনে আগ্রাসনের বিষয়ে রিয়াদ অনেকটা ছাড় পেয়ে এসেছে। বাইডেনের সময় এই দৃষ্টিভঙ্গির বদল লক্ষ করা যাচ্ছে।
এর আগে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সংশ্লিষ্টতা ছাড়া দেশটির সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ড সম্ভব ছিল না বলে মন্তব্য করেন জাতিসংঘের বিশেষ দূত অ্যাগনেস ক্যালামার্ড। বিচারবহির্ভূত হত্যা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ক্যালামার্ড বলেন, সুনির্দিষ্ট প্রমাণ না থাকলেও তিনি যুবরাজকেই প্রধান সন্দেহভাজন মনে করছেন।
জানা যায়, সুপরিচিত সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগি সৌদি আরবের বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার হয়ে আফগানিস্তানে সোভিয়েত অভিযান এবং আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনের উত্থানসহ গুরুত্বপূর্ণ গটনা কাভার করেন। ৫৯ বছর বয়সী জামাল খাসোগি বেশ কয়েক দশক সৌদি রাজ পরিবারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং সৌদি সরকারের উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছেন। ২০১৭ সাল থেকে তিনি আমেরিকায় স্বেচ্ছা নির্বাসনে যান। সেসময় থেকেই তিনি ওয়াশিংটন পোস্টে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের কার্যক্রম সমালোচনা করে প্রতি মাসে কলাম লিখতেন। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে তার প্রথম কলামে তিনি যুবরাজের বিরোধিতা করার জন্য গ্রেফতার হতে পারেন বলে আশঙ্কাও প্রকাশ করেছিলেন।
পরে ২০১৮ সালের অক্টোবরে ইস্তানবুলের সৌদি কনস্যুলেটে প্রবেশের পর নিখোঁজ হন সৌদি ভিন্নমতাবলম্বী ও ওয়াশিংটন পোস্টের কলামিস্ট জামাল খাসোগি। বিশ্বজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হলে তাকে হত্যার কথা স্বীকার করে রিয়াদ কর্তৃপক্ষ। তাদের দাবি, জিজ্ঞাসাবাদের সময় কর্মকর্তাদের ভুলে নিহত হন ওই সাংবাদিক। তবে তার মৃতদেহের কোনও সন্ধান পাওয়া যায়নি। সৌদি আরব প্রথমে খাসোগি খুন হওয়ার কথা অস্বীকার করে। পরে তারা স্বীকার করতে বাধ্য হয়।
তবে সৌদি কৌঁসুলি সেসময় বলেছিলেন যে এই হত্যা পূর্ব পরিকল্পিত ছিল না। সৌদি কর্মকর্তারা বলে আসছেন, সৌদি আরবের একটি দুর্বৃত্ত দলের হাতে এই সাংবাদিক খুন হয়েছিলেন। আর হত্যার নির্দেশও ঐ দলের প্রধানের কাছ থেকেই এসেছিল। ঐ দলটিকে খাসোগির সাথে ‘আলোচনা’ করে তাকে ‘বুঝিয়ে, বা সম্ভব না হলে জোর করে’ সৌদি আরবে ফিরিয়ে নিতে মানানোর জন্য পাঠানো হয়েছিল বলে বলেছিলেন তারা। কিন্তু ঘটনার সাথে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সম্পৃক্ততার অভিযোগ সবসময়ই অস্বীকার করে দেশটির কর্মকর্তারা।
সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের পর শুরু থেকেই সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে রক্ষা করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি পুনরায় এ ঘটনায় যুবরাজ সালমানের সম্পৃক্ততা নেই বলে তার দৃঢ় বিশ্বাসের কথা জানান। ডোনাল্ড ট্রাম্প তখন বলেন, ‘এ হত্যায় যুবরাজ সালমানের কোনো হাত নেই। সৌদি আরব আমাদের সত্যিকারের একজন ঘনিষ্ঠ মিত্র। তারা আমাদের অনেক কাজ ও ব্যবসার জন্য অনেক সুযোগ দেয়। যা অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।’
এমন মন্তব্যের মাধ্যমে ডোনাল্ড ট্রাম্প তার ঘনিষ্ঠ মিত্র সৌদি আরবের বাদশাহ ও বন্ধু সালমানের পক্ষ হয়েই কথা বলছেন। আর তার বক্তব্যে এটা পরিস্কার যে, একজন সাংবাদিকের জীবন তার লাভজনক অস্ত্র ব্যবসা আর বাণিজ্য চুক্তিকে হুমকির মুখে ঠেলে দিতে পারে না।
তবে খাসোগি হত্যা নিয়ে সৌদি আরবের ওপর সবচেয়ে বড়ে চাপটি আসছে তুরস্কের পক্ষ থেকে। দেশটি বলছে ওইদিন কনস্যুলেটে ঢোকার পরপরই খাসোগিকে হত্যা করে তার মরদেহ টুকরো টুকরো করা হয়। আর পরিকল্পনা অনুযায়ী তার মরদেহ অদৃশ্য করে দেয় সৌদি আরবের পাঠানো ১৫ সদস্যেল কিলিং স্কোয়াড।
ঘটনার প্রায় একমাস পর তুরস্কের পক্ষ থেকে বলা হয় খাসোগি হত্যার অডিও রেকডিং তাদের হাতে আছে। এছাড়া তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান বলেছেন, পশ্চিমা মিত্র দেশগুলোর কাছে খাশোগি হত্যার রেকডিং পাঠিয়েছে আঙ্কারা।
তুরস্কের এই একটু একটু করে তথ্য দেয়ার কারণে সৌদি কর্মকর্তরা খাসোগি হত্যা নিয়ে তাদের গল্প বদলাতে বাধ্য হচ্ছেন। আর এর মাধ্যমেই মূলত সৌদি আরব বলতে বাধ্য হয়েছে যে, খাসোগিকে পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা হত্যা করেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬০০
আপনার মতামত জানানঃ