বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন : ক্ষমতায় দীর্ঘদিন টিকে থাকার জন্য সেনাবাহিনীর আনুগত্য কিনে নিয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্দেশ্যজনকভাবে সেনাবাহিনীকে বিভিন্ন অজুহাতে টাকা এবং বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আছেন বলে ইকোনোমিস্টের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার(১১ ফেব্রুয়ারি) ইকোনমিস্টের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্টোকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস ইনস্টিটিউশনের জরিপ অনুসারে, সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের কোনো ধরনের হুমকি ছাড়াই শেখ হাসিনা সেনাবাহিনীর উপর অযথা খরচ বাড়িয়ে চলেছেন। ২০০৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এই খরচ বেড়ে ১২৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে সেনাবাহিনী তাদের ব্যবসায়ীক মনোভাব ক্রমশ বাড়িয়ে চলেছেন। এরইমধ্যে তারা বাংলাদেশ আর্মি ওয়েলফেয়্যার ট্রাস্ট এবং সেনা কল্যাণ সংস্থা গড়ে তুলেছেন। সৈন্য এবং প্রবীণদের জন্য গড়া এই দুটি সংগঠন সেনাবাহিনীর স্বতন্ত্র হয়ে কাজ করে কিন্তু পরিচালনা করা হয় কর্মকর্তাদের দিয়ে। সংস্থা দুটির ওয়েবসাইট অনুসারে, সেনা কল্যাণ সংস্থার এই মুহূর্তে ৬০ বিলিয়ন টাকার সম্পত্তি রয়েছে এবং আর্মি ওয়েলফেয়্যার ট্রাস্টের সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন বিলাসবহুল হোটেল এবং একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে জাতীয় নির্বাচনের জন্য ভোটিং মেশিন প্রস্তুত করা হয়। এসব মেশিন তৈরীর জন্য নিয়ম থাকলেও কোনো টেন্ডার ডাকা হয়নি। গোয়েন্দাসংস্থাসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা শুরু থেকেই অভিযোগ করে আসছেন যে, এখানে ভোটিং মেশিন এমনভাবে ডিজাইন করা হয় যেন ভোট কারচুপিতে সহজ হয়।
সেনাবাহিনী সরকারের তরফ থেকে অনেকগুলো অবকাঠামো প্রকল্পও পরিচালনা করেন বলে জানিয়েছেন ইকোনোমিস্ট। আল জাজিরা যেসবের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে – এসব অত্যন্ত উদ্বেগের বলে জানিয়েছে ইকোনোমিস্ট। তারা জানায়, প্রত্যন্ত দ্বীপে রিফিউজি ক্যাম্প তৈরি করতে নৌবাহিনী 300 মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছিল। রাজধানী ঢাকায় মূল বিমানবন্দর সম্প্রসারণের দায়িত্ব দেওয়া হয় বিমান বাহিনীকে। হাইওয়ে নির্মাণ পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় সেনাবাহিনীকে। এছাড়া বাহিনীর সিনিয়র কর্মকর্তাদের ঘণবসতিপূর্ণ ঢাকা শহরে জমি দেয়াসহ আরো বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়। তারা সকলেই এমন প্লট পান যার উপরে তারা সাত এপার্টমেন্ট সংশ্লিষ্ট সাত তলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণের অধিকার পান। বাহ্যিকভাবে এটি আবাসন ভাতার একটি রুপ হলেও সিনিয়র অফিসাররা কয়েকটি ফ্ল্যাট বিপুল মূল্যে বিক্রি করে। চাকরি চলাকালীন অনেককে এবং অবসরপ্রাপ্ত অনেকেই জাতীয় বন্দর কর্তৃপক্ষ ও চা চাষ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার মতো জায়গাতে উচ্চপদস্থ সরকারি চাকরি দিয়ে থাকেন। এমনকি যারা নিচের র্যাংকে আছেন তাদের জন্যও রয়েছে লাভজনক প্রগলভতা। সরকার শান্তিরক্ষা মিশনে মোতায়েন করা প্রতিটি বাংলাদেশী সৈন্যের জন্য জাতিসংঘ থেকে প্রাপ্ত প্রায় ১০,০০০ ডলার ব্যয় করে।
ইকোনমিস্ট জানায়, প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপির তুলনায় সেনাবাহিনীতে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা অতোটা ভালো অবস্থানে ছিল না। কেননা, শেখ হাসিনা এক রাজনৈতিক পরিবার থেকে এলেও প্রতিপক্ষ দলের সভানেত্রী বেগম খালেদা জিয়া দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন সেনাবাহিনীর একজন সাবেক মেজরের স্ত্রী হিসাবে। খালেদা জিয়ার স্বামী একসময় সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন, একইসাথে মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্রবাহিনীর অন্যতম কমান্ডার ছিলেন। সেই সুবাধে সেনাবাহিনীর নিকট বিএনপি জনপ্রিয় থাকলেও পিছিয়ে ছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এলে সেনাবাহিনী থেকে বিএনমিপন্থীদের উচ্ছেদ করে তার আনুগত্যদের সামনের সারিতে টেনে নিয়ে আসেন। জেনারেল আজিজ আহমেদ তাদেরই একজন। একইসাথে সেনাবাহিনীকে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিয়ে কাছে টেনে আনেন। সেনাদের নিকট-আত্মীয়দের আর্মি হসপিটালে সেবা নেওয়ার সুযোগ করে দেন, যে হাসপাতাল দেশের সেরা হাসপাতাল হিসাবে বিবেচিত। এমনকি ২০১৫ সালে সেনাদের বেতন দ্বিগুণ করে দেন।
এসব ছাড়াও সেনাবাহিনীকে নিজের করে রাখার জন্য সেনাপ্রধানকে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা ও ছাড় দিয়ে থাকেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ। সম্প্রতি কাতারভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আল জাজিরার প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সেনাপ্রধান ও তার ভাইদের মাফিয়াগিরির যে তথ্যচিত্র প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে উঠে আসে, সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ভাই আলোচিত খুনের ফেরারি আসামি হলেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ লক্ষণীয় নয়। কেবল তাই নয়, খুনের ফেরারি আসামি হলেও তারা সরকারি বিভিন্ন কাজের চুক্তি পেয়ে থাকেন। সরকারি বাহিনীকে ব্যবহার করে টাকার কুমির বনে যাচ্ছেন তারা। সরকারের প্রশ্রয়েই সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের ভাইয়েরা বিদেশে বসেও বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা ব্যবসা করেন। এসব বিষয়ে শেখ হাসিনা ওয়াকিবহাল থাকলেও কখনো পদক্ষেপ নেননি, এমনকি তার তরফ থেকে এটাকে সবুজ সংকেত জ্বালিয়ে রাখাকেই প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন। এসব বিষয় নিয়ে আল জাজিরা তথ্যচিত্র প্রকাশ করলেও শেখ হাসিনাকে উল্টো তাদেরই পক্ষ নিতে দেখা গেছে। আল জাজিরার প্রতিবেদনকে উল্টো ‘গালগল্প’ ও ‘রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্র’ বলে সেনাপ্রধান ও তার ভাইদের রক্ষা করার চেষ্টা করতে দেখা গেছে।
ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার জন্যই যে কেবল সেনাবাহিনীকে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিয়ে শেখ হাসিনা সেনাবাহিনীকে কব্জা করে রেখেছেন তা নয়। ইকোনমিস্টের দাবি, সেনাবাহিনীকে কব্জা করে রাখার পেছনে শেখ হাসিনার পিতৃহত্যার প্রতিশোধও লুকিয়ে আছে। শেখ হাসিনার পিতা জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালে সপরিবারে নিহত হন। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনা দুই বোন ঐসময় দেশের বাইরে ছিলেন বিধায় হত্যাযজ্ঞের কবল থেকে বেঁচে ছিলেন। ’৭৫ এর ওই আলোচিত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল এই সেনাবাহিনীই যারা তাকে এখনো ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছেন। এখানে শেখ হাসিনা পরস্পরবিরোধী দুটি অবস্থানের একটিকে বেছে নিলেন। পিতৃহত্যার প্রতিশোধ না নিয়ে অথবা পিতৃহত্যার প্রতিশোধ হিসাবেই সেনাবাহিনীকে নিজের করায়ত্বে নিয়ে এলেন যাতে তিনি ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেন। এটাকে রাজনৈতিক কৌশল হিসাবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।
ইকোনমিস্ট বলছে, যদিও স্বাধীনতার ৫০ বছরের মধ্য ১৫ বছরই শাসন করেছে সেনাবাহিনী, এবার শেখ হাসিনাকে দিয়ে তারাই শাসন করছে। আর শেখ হাসিনাও সেনাবাহিনীর আনুগত্য কিনে সরকারের মধ্যমণি করে রেখেছেন। তবে রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর দীর্ঘসূত্রতাও বেশিদিন টেকার নয় বলে জানিয়েছেন ইকোনোমিস্ট। কেননা শেখ হাসিনার যোগ্য কোনো উত্তরসূরি না থাকায় শেখ হাসিনার সাথেই সেনাবাহিনীও রাজনীতি থেকে উধাও হয়ে যাবে।
সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা মনে করেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য কেবল সেনাবাহিনীই নয়, অন্যান্য বাহিনীকেও নিজের আয়ত্বে নিয়ে এসেছেন। এর ফলে তাকেও দিতে হচ্ছে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা। তারই অংশ হিসাবে আল জাজিরা সেনাপ্রধানের ভাইদের বিরুদ্ধে তথ্য প্রচার করলেও শেখ হাসিনা তার প্রতিবাদ করেছেন। এমনকি মাঠেও নেমেছেন। তবে বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, শেখ হাসিনা সেনাপ্রধান ও তার ভাইদের রক্ষার মাধ্যমে মূলত নিজেকেই রক্ষা করছেন। সেনাপ্রধান ও তার ভাইদের দিকে টার্গেটকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকে টার্গেট বলেই ভাবতে চান তারা। তবে এক্ষেত্রে একমত হন যে, শেখ হাসিনা সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য বাহিনীদের অতিরিক্ত সুযোগ সুবিধা দিয়ে যাচ্ছেন মূলত নিজের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার কৌশল হিসাবে।
এসডব্লিউ/কেএইচ/১৬১৬
আপনার মতামত জানানঃ