২০১৭ সালে রাখাইনে গণহত্যা ও সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে একজনকেও এখনো ফেরানো সম্ভব হয়নি। দ্বিপক্ষীয় চুক্তি সত্ত্বেও মিয়ানমার সরকারের টালবাহানায় প্রতিবারেই তা থমকে গেছে। মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চিকে গ্রেফতার ও সামরিক অভ্যুত্থানের জেরে অনেকটাই চাপা পড়ে যায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যু।তবে অবশেষে গতকাল সোমবার(০৮ ফেব্রুয়ারি) মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং অভ্যুত্থানের পরে টেলিভিশনের দেওয়া প্রথম ভাষণে নিয়ম মেনেই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি অনুসারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনেও সমস্যা হবে না বলে জানিয়েছেন তিনি।
তিনি বলেছেন, আমরা দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশ থেকে গৃহহীনদের ফেরত নেওয়া অব্যাহত রাখব।
ভাষণে রোহিঙ্গা পুনর্বাসন ইস্যুতে তিনি বলেন, মিয়ানমারের ভেতরে অস্থায়ী শিবিরগুলোতে যত বাস্তুচ্যুত লোকজন রয়েছেন, তাদের পুনর্বাসন কার্যক্রমও অব্যাহত থাকবে।
মিয়ানমার সেনাপ্রধান বলেছেন, আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে হওয়া চুক্তি বাস্তবায়ন করা হবে। এক্ষেত্রে অবশ্য একটি শর্ত দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘চুক্তি বাস্তবায়ন হবে, যদি তা দেশের স্বার্থের পরিপন্থী না হয়।’
মিন অং হ্লাইংয়ের ভাষ্যমতে, বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের মধ্যে যারা ‘গ্রহণযোগ্য’, ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব অনুযায়ী তাদেরই ফেরার অনুমতি দেওয়া হবে।
তবে যে সেনাবাহিনীর অত্যাচার নির্যাতনে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে সেই জান্তা সরকারের কাছে তারা কতটুকু নিরাপদ তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। সেনা অভ্যুত্থানের কারণে নতুন করে রোহিঙ্গা ঢলেরও আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলেন, রাখাইনে ছয় লাখের মত রোহিঙ্গা রয়েছে। তাদেরকে আবারও জোর করে বিতাড়িত করা হবে না সে নিশ্চয়তা নেই। সে বিষয়ে আমাদের নজর রাখতে হবে।
বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য শুরু থেকেই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার ওপর জোর দিয়ে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালের নভেম্বরের ২৩ তারিখ বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে একটা প্রত্যাবাসন চুক্তি হয়। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের ১৯ তারিখ একটা টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে একটা ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ চুক্তি হয়, যার শর্ত অনুযায়ী প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকে দুই বছরের মধ্যে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হবে। তার ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বরের এবং ২০১৯ সালের ২২ আগস্ট দুই দফা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হলেও সেটা ব্যর্থ হয়, কারণ রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি হয়নি।
রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরতে রাজি না হওয়ার কারণ হচ্ছে, মিয়ানমার তাদের কোথায় নিয়ে যাবে, তাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়া হবে কি না, তাদের জীবনের নিরাপত্তা দেওয়া হবে কি না, তাদের মানবিক মর্যাদা দেওয়া হবে কি না, তাদের ফেলে আসা বসতভিটা ফেরত দেওয়া হবে কি না তার কোনো বিশ্বাসযোগ্য আশ্বাস তারা দেশটির পক্ষ থেকে পায়নি। ফলে প্রথম এবং দ্বিতীয় দফা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ব্যর্থ হয়।
২০২০ সালে করোনাভাইরাসের প্রকোপের কারণে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া প্রায় বন্ধ ছিল কিন্তু ২০২১ সালের জানুয়ারির ১৯ তারিখ চীনের দূতিয়ালিতে আবার প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য বাংলাদেশের ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু হঠাৎ করে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে এ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে কি না, তা নিয়ে একটা শঙ্কা ও সংশয় তৈরি হয়েছিল।
তবে সেনাপ্রধানের এই ঘোষণায় অনেকটাই আশার আলো দেখছে বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সু চির সরকার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিয়ে যেভাবে এগোচ্ছিল এবং বাংলাদেশের সঙ্গে যে চুক্তি করেছিল তাতে সামরিক বাহিনীর সমর্থন ছিল। সুতরাং সামরিক সরকারও সে প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখবে আশা। তা ছাড়া ২০১৭ সালের নভেম্বরের ২৩ তারিখ যে প্রত্যাবাসন চুক্তি হয়েছিল, সেটা ব্যক্তি সু চির সঙ্গে হয়নি কিংবা সু চির নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গে হয়নি, চুক্তি হয়েছিল মিয়ানমার রাষ্ট্রের সঙ্গে। ফলে সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়াটি আবার নতুন সরকারের সঙ্গে করায় কোনো বাঁধা থাকার কথা নয় বলে মনে করেন তারা। এরইমধ্যে জান্তা সরকার প্রধানের এই ঘোষণায় অনেকটাই আশার আলো দেখা যাচ্ছে।
এর আগে মিয়ানমারের সামরিক সরকার ইয়াঙ্গুনে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে বাংলাদেশকে চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে দেশটিতে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের কেন দরকার পড়লো বাংলাদেশকে তারা সেটির ব্যাখ্যা দিয়েছে। গত শনিবার(০৬ ফেব্রুয়ারি) পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন সাংবাদিকদের একথা জানিয়েছেন। এই নতুন সরকারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সেদিন সাংবাদিকদের তিনি বলেছিলেন, ’আমাদের কাছে খবর এসেছে যে মিলিটারি কমান্ডাররা রাখাইনে অবস্থিত রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে গিয়েছিলেন এবং তাদের সঙ্গে আলাপ করেছেন। রোহিঙ্গারা তাদের অভিযোগের কথা বলেছে যে তারা চলাফেরা করতে পারে না। আর্মি সরকার বলছে, আমরা তোমাদের অবস্থার পরিবর্তন করবো, ধাপে ধাপে অবস্থার পরিবর্তন করবো। এগুলো শুনে কুতুপালং ক্যাম্পে খুব উৎসাহ হচ্ছে। তারা খুশি যে আর্মিরা তাদের অভয় দিচ্ছে। এটি ভালো খবর।
সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের চলমান দ্বন্দ্ব নিরসনে দেশটির সামরিক বাহিনী বাংলাদেশকে কাছে টানতে চাইছে। মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থান নিয়ে যখন পশ্চিমা দেশগুলো নিন্দা জানিয়ে আসছিল ক্রমাগত, এই মুহূর্তে সামরিক সরকার কর্তৃক বাংলাদেশকে চিঠি মারফতে অভ্যুত্থানের কৈফিয়ত দেওয়াকে বাংলাদেশকে তারা কাছে টানতে চাইছেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা। একইসাথে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সামরিক বাহিনীর ইতিবাচক আচরণের বিষয়টাকেও একই উদ্দেশ্য বলে মনে করছেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৩৯
আপনার মতামত জানানঃ