মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য স্থিতিশীল রাখতে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক রেকর্ড পরিমাণ ডলার কিনেছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে। রেমিট্যান্সের উচ্চপ্রবাহ ও আমদানি কমে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি অর্থবছরের ছয় মাসেই ডলার ক্রয়ের আগের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ৫ বিলিয়ন ডলার কিনে নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, টাকার হিসাবে যা ৪৬ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা। এ সংখ্যা ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় প্রায় সাতগুণ বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার কিনে নেওয়ার কারণে টাকার মূল্য স্বাভাবিক রয়েছে, একই সময়ে ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর মুদ্রার মান বেড়ে গেছে বহুগুণে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ উদ্যোগ দেশে রপ্তানি ক্ষেত্র বিস্তৃত হচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
২০১৯ সালের ১৫ নভেম্বর টাকা-ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৪ টাকা ৭৫। চলতি বছরের ৩০ জুন শেষে তা কিছুটা বেড়ে ৮৪ টাকা ৯৫ পয়সায় উঠেছিল। কয়েক দিনের মাথায় তা ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় নেমে এসে এখনও সেই দরে লেনদেন হচ্ছে। এই মুহূর্তে বাজার থেকে ডলার কিনে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ঠিক কাজটিই’ করেছে বলে মনে করেন অর্থনীতির গবেষকরা। তারা মনে করেন, মহামারীর এই কঠিন সময়েও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে উল্লম্ফন এবং বিদেশি ঋণ সহায়তা ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধির কারণে বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার না কিনলে বাজারে ডলারের দর কমে যাবে। তখন টাকার মানও বেড়ে যাবে। এ কারণে টাকার দরপতন ঠেকাতে বাজার থেকে ডলার কিনে সঠিক কাজটিই করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে রপ্তানি বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।
এক বছর আগেও ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর মুদ্রার তুলনায় টাকার মান বেড়ে যাওয়ায় রপ্তানিতে পিছিয়ে পড়ছিল বাংলাদেশ। রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামের মুদ্রার মান কমে যাওয়ায় দেশটি দ্রুতগতিতে রপ্তানির বাজার দখল করে নিচ্ছিল, মহামারির সময় জুন থেকে ডলারের বিপরীতে ভিয়েতনামিজ ডং-এর মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে দশমিক ৩৮ শতাংশ। একই সময়ে ডলারের বিপরীতে কম্বোডিয়ান রিয়েলের মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে দশমিক ৭৬ শতাংশ ও ইন্দোনেশিয়ান রুপিয়াহর মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে দশমিক ৮৫ শতাংশ।
সম্প্রতি ব্যাংকারদের এক বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, মহামারির সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র দশমিক ১২ শতাংশ, সেসময় চীনা ইউয়ানের মূল্য বেড়েছে সর্বোচ্চ ৮ দশমিক ৯৫ শতাংশ। অন্যদিকে ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রূপির মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৪১ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টদের মতে, মহামারির সময়ে রপ্তানিকারকরা অর্ডারের অভাবে পড়লে, প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর মুদ্রার মান ডলারের বিপরীতে উচ্চহারে বেড়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে এর সুফল পেয়েছে বাংলাদেশের স্থানীয় রপ্তানিকারকরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক (গবেষণা) ড. মো হাবিবুর রহমান জানান, ডলারের বিপরীতে দেশীয় মুদ্রার মান বেড়ে গেলে রপ্তানির বাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমে যায়, অন্যদিকে ডলারের বিপরীতে মুদ্রার অবচয় (মান কমে গেলে) হলে, রপ্তানির বাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বেড়ে যায়।
তিনি জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপের কারণে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর তুলনায় ডলারের বিপরীতে টাকার মান খুব বেশি বৃদ্ধি পায়নি। ফলস্বরূপ, রপ্তানির বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বেড়েছে।
দেশে বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহ বেশি থাকলে, দেশীয় মুদ্রার মান কমে যায়। বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বেশি থাকা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার কিনে নেওয়ার কারণে টাকার মূল্য কিছুটা বেড়েছে।
রেমিট্যান্সপ্রবাহ বেড়ে যাওয়া ও ডলারের চাহিদা কমে যাওয়ায় বাজারে উদ্বৃত্ত ডলার থেকে যাচ্ছে। বিনিয়োগে চাহিদা কম। আমদানিও কমে গেছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহার করতে না পারায় ব্যাংকগুলোকে বাধ্য হয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ডলার নিয়ে আসছে। বাধ্য হয়ে তা কিনছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল রাখার স্বার্থেই ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ডলার কিনছে। এ ডলারের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্থানীয় মুদ্রা দিচ্ছে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার কেনা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। কারণ বাজারে চাহিদা কমে যাওয়ায় ডলার উদ্বৃত্ত থাকছে। না কিনলে ডলারের দাম কমে যাবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন প্রবাসীরা। ফলে রেমিট্যান্স পাঠাতে তারা নিরুৎসাহিত হবেন। অন্যদিকে রপ্তানি আয়ও কমে যাবে। এসব কথা চিন্তা করেই বাজার থেকে ডলার কিনতে হচ্ছে; অন্যথায় ডলার অবমূল্যায়ন হতো।
মার্চে করোনাভাইরাস মহামারীর প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার শুরুর দিকে ধস নামলেও পরে রপ্তানি আয় ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কমে যাওয়ার আশঙ্কার বদলে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে উল্লম্ফন অব্যাহত রয়েছে। তারসঙ্গে বেড়েছে বিদেশি ঋণ সহায়তাও। অন্যদিকে আগের সময়ের চেয়ে আমদানি ব্যয় কমছে।
বিদেশি লেনদেনের ক্ষেত্রে ডলারের মান স্থিতিশীল রাখতেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন জানান, মুদ্রার অবচয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের তুলনায় পিছিয়ে থাকায়, ডলারের বিপরীতে কম হারে টাকার মুল্যবৃদ্ধি রপ্তানিকারকদের জন্য সহায়ক হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার না কিনলে ডলারের বিপরীতে টাকার মান আরও বেড়ে যেতো। ভারতে আমদানি কমে গিয়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় ডলারের বিপরীতে রূপির মূল্য উচ্চহারে বেড়ে যায়। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বৈদেশিক বিনিময় বাজারে হস্তক্ষেপ করেনি। ফলে বাংলাদেশে ডলারের মান প্রায় স্থিতিশীল হলেও ভারতে ডলারের মান অস্থিতিশীল ছিল বলে জানান ড. জাহিদ হোসেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ উদ্যোগ রপ্তানিকারকদের সহায়তা করলেও, এতে আর্থিক খাতে দেখা দিয়েছে অতিরিক্ত তারল্যের চাপ। করোনা মহামারির কারণে ব্যবসায়িক মন্দা থাকায় কমে গেছে ঋণের চাহিদা। ফলে, ব্যাংকে অলস টাকার পরিমাণ বেড়েই চলেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত অক্টোবরে ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ ছিল এক লাখ ৮২ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা। আগের বছরের তুলনায় এ পরিমাণ ২০২ শতাংশ বেশি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে ডলার কিনলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ে। ডলার বিক্রি করলে রিজার্ভ কমে যায়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে রিজার্ভ বেড়ে যাওয়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে রেমিটেন্স। এরসঙ্গে যোগ হয় ডলার কেনা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৪২
আপনার মতামত জানানঃ