আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, খুন, ভারতে অর্থ পাচারসহ নানা অভিযোগ রয়েছে সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত আলীর বিরুদ্ধে। অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র প্রদান করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২ কোটি ৭৩ লাখ ৯ শত ৫২ টাকার অবৈধ সম্পদ সংরক্ষণের অপরাধে তার বিরুদ্ধে দাখিলকৃত একটি মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।
জানা যায়, ২০১৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের রমনা থানায় তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের অভিযোগ এনে মামলা করেন দুদক প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. সাইদুজ্জামান। পরবর্তীতে মামলার তদন্তভার দেয়া হয় সিলেট জেলা সমন্বিত কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. ইসমাইল হোসেনকে। দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২৭ জানুয়ারি ঢাকার মহানগর দায়রা জজ ও সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন ইসমাইল।
দুদক সূত্রে জানা যায়, দুদকের পক্ষ থেকে লিয়াকতের সম্পদের হিসেব চাওয়া হলে তিনি স্থাবর সম্পত্তি হিসেবে মোট ১ কোটি ৩৪ লক্ষ, ১২ হাজার ৯ শত ১৪ টাকা ও অস্থাবর সম্পত্তি হিসেবে ৮১ লক্ষ ৭৪ হাজার ৮ শত ১৩.০৮ টাকা দেখালেও তিনি সম্পদের প্রকৃত হিসেব গোপন করেন। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। পরে তদন্ত করে দেখা যায় ব্যবসা ও দান হিসেবে তিনি বৈধভাবে সম্পদ অর্জন করেছেন মাত্র ৫৯ লক্ষ ৭৮ হাজার ৮ শত ৭৮ হাজার টাকা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে লিয়াকতের নামে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি মিলে ৩ কোটি ৩২ লাখ ৮৭ হাজার ৯ শত ৩০ টাকা পরিমাণ। সে হিসেবে লিয়াকতের অবৈধ সম্পদের পরিমাণ ২ কোটি ৭৩ লাখ ৯ শত ৫২ টাকা। এ ঘটনায় জৈন্তাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত আলীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন-২০০৪ এর ধারা ২৭ (১) ও ২৬ (২) আনুযায়ী অবৈধ সম্পদ ভোগদখল ও মিথ্যা তথ্য প্রদানে অপরাধ করেছেন মর্মে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করা হয়।
তবে জৈন্তাপুর উপজেলায় পাথর সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণকারী এই আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে আগেও একাধিকবার মামলা হয়েছে। উপজেলার শ্রীপুর পাথর কোয়ারির দখল নিয়ে গত বছরে একজন নিহত হবার ঘটনায় একটি হত্যা মামলায় আসামী হন লিয়াকত। এ মামলায় বেশ কয়েক মাস কারাভোগের পর জামিনে বেরিয়ে আসেন তিনি। এই মামলায় হাজিরা দিতে গিয়ে আদালত চত্বরে যমুনা টিভি সিলেট ব্যুরোর ভিডিও জার্নালিস্ট নিরানন্দ পাল ও যুগান্তরের ফটো সাংবাদিক মামুন হাসানের উপর আক্রমন করে লিয়াকত আলীর সহযোগীরা। এ ঘটনায়ও মামলার আসামী হন তিনি। এর আগে সরকারি সম্পত্তি বিক্রি করে দেবার অভিযোগে দুদক আইনে একটি মামলার আসামী হন লিয়াকত আলী। সিলেটের সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতে এ মামলা করেন উপজেলার দরবস্ত ইউনিয়নের করগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের ছেলে মো. মনির আহমদ।
আলোচিত আওয়ামী লীগ নেতা লিয়াতক আলীর বিরুদ্ধে অবৈধ উপায়ে পাথর সংগ্রহ করে পরিবেশ ধ্বংসের অভিযোগ রয়েছে। লিয়াকত আলী একসময় স্থানীয় জলমহালের পাহারাদার ছিলেন। পরে বালু-পাথর ব্যবসার নামে অবৈধ পাথর উত্তোলনযন্ত্র পরিচালনা করে রাতারাতি টাকাওয়ালা বনেছেন। শূন্য থেকে এখন কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রভাবে লিয়াকত জৈন্তাপুর ছাড়াও গোয়াইনঘাটের জাফলং ও বিছনাকান্দি এলাকায় অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে সন্ত্রাসী বাহিনী লালন করছেন। জৈন্তাপুরের আলুবাগান এলাকায় খাসিয়া সম্প্রদায়ের জমি অবৈধ দখল করে বানকান স্টোন ক্রাশার নামে একটি পাথর ভাঙার অবৈধ কল, মোকামপুঞ্জিতে বাংলোবাড়ি, খাসিয়া হাটিতে বানিয়ল হাউস নামে কয়েক কোটি টাকা মূল্যের বাড়ি ক্রয়, জৈন্তাপুর বাসস্টেশন এলাকায় কোটি টাকা মূল্যের অর্পিত সম্পত্তি জাল কাগজ বানিয়ে তার (লিয়াকত) ভাইয়েরা দখল করেছেন। এ ছাড়া সিলেটের বটেশ্বর এলাকায় কোটি টাকা মূল্যের বাড়ি এবং নগরের সুবিদবাজার এলাকায় ফ্ল্যাটবাড়ির মালিক হয়েছেন লিয়াকত।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দলীয় প্রভাব খাটিয়ে অবৈধ সম্পদ অর্জনে এমন লিয়াকত আলী রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়েছে। মূলত এভাবে লুটেপুটে খাওয়ার জন্যই দলীয় পদবী কিংবা নির্বাচিত যেকোনো পদ নিজেদের দখলে নিয়ে নিজেদের অপতৎপরতা চালান। স্থানীয়রাও তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার সাহস পান না। সরকারি বেসরকারি সমস্ত স্তরেই রয়েছে এদের অবৈধ অবাধ বিচরণ। রাতারাতি বিশাল সম্পত্তির মালিক বনে যাওয়ার জন্য হেন কোনো কাজ বাদ রাখেন না। কেননা তাদের বিরুদ্ধে সরকার কিংবা প্রশাসনও অতোটা সরব থাকেন না। বলা চলে উভয়পক্ষকেই টাকার বিনিময়ে নিজেদের পকেটেই পুরে রাখেন তারপর নিজেদের অপকর্ম চালান নির্বিঘ্নে। এসব বিষয়ে সরকারের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ দাবি করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৫৬
আপনার মতামত জানানঃ