সিডনির বন্ডাই বিচ অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে পরিচিত সমুদ্রসৈকতগুলোর একটি। নীল জলরেখা, সাদা বালু, পর্যটকের ভিড়, সার্ফারের ঢেউ ধরার প্রতিযোগিতা—এই সবকিছুর মাঝেই রবিবারের সকালে হঠাৎ করে বন্দুকের শব্দ যেন পুরো দৃশ্যপটটাই পাল্টে দেয়। যে জায়গাটি আনন্দ, উৎসব আর নিরাপদ জীবনের প্রতীক হিসেবে পরিচিত ছিল, কয়েক মিনিটের মধ্যেই তা পরিণত হয় মৃত্যু, আতঙ্ক আর শোকের কেন্দ্রে। এই হামলায় ১৫ জন মানুষ প্রাণ হারান, আহত হন আরও অন্তত ২১ জন। ঘটনাটি শুধু অস্ট্রেলিয়াকেই নয়, নাড়িয়ে দেয় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও।
এই হামলার কেন্দ্রবিন্দুতে যে দুজনের নাম উঠে এসেছে, তারা হলেন সাজিদ আকরাম এবং তার ২৪ বছর বয়সী ছেলে নাভিদ আকরাম। পুলিশের ভাষ্যমতে, হামলাকারীদের একজন ঘটনাস্থলেই নিহত হন। পরবর্তীতে তদন্তে জানা যায়, সাজিদ আকরাম মূলত ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর হায়দ্রাবাদ থেকে অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসী হিসেবে গিয়েছিলেন। ভারতীয় রাজ্য তেলেঙ্গানার রাজধানী হায়দ্রাবাদেই তার পরিবারের শিকড়। কিন্তু পুলিশ ও পরিবারের বক্তব্য অনুযায়ী, বহু বছর ধরেই তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল সীমিত।
সাজিদ আকরাম ১৯৯৮ সালে অস্ট্রেলিয়ায় যান উচ্চশিক্ষা ও কাজের সন্ধানে। এরপর দীর্ঘ সময় ধরে তিনি সেখানেই বসবাস করছিলেন। প্রায় তিন দশকের মধ্যে তিনি মাত্র ছয়বার ভারতে গিয়েছেন বলে জানিয়েছেন তেলেঙ্গানা পুলিশের এক কর্মকর্তা। সেই সফরগুলোও ছিল মূলত পারিবারিক প্রয়োজনে—সম্পত্তি সংক্রান্ত বিষয় বা বয়স্ক বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য। এমনকি তার বাবার মৃত্যুর সময়েও তিনি ভারতে যাননি। পরিবার দাবি করছে, সাজিদের কোনো উগ্রবাদী চিন্তাধারা বা সহিংস কার্যক্রম সম্পর্কে তারা কিছুই জানতেন না।
তদন্তে উঠে এসেছে, সাজিদ আকরাম ভারতীয় পাসপোর্টধারী ছিলেন। তবে তার সন্তানরা অস্ট্রেলিয়ায় জন্ম নেওয়ায় তারা সে দেশের নাগরিক এবং অস্ট্রেলিয়ান পাসপোর্ট ব্যবহার করতেন। সাজিদ নিজেও অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ী জীবন গড়ে তুলেছিলেন, ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত এক নারীকে বিয়ে করেছিলেন এবং বহিরঙ্গে তাকে একজন সাধারণ অভিবাসী হিসেবেই দেখা হতো। এই পরিচিত চিত্রের আড়ালেই যে চরমপন্থার বীজ গড়ে উঠছিল, তা পরিবারের কাছেও স্পষ্ট ছিল না বলে দাবি করা হচ্ছে।
রবিবারের হামলাটি ঘটে বন্ডাই বিচে ইহুদি ধর্মীয় উৎসব হানুকাহ উপলক্ষে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানের সময়। পুলিশ শুরু থেকেই ঘটনাটিকে সন্ত্রাসী হামলা হিসেবে বিবেচনা করছে। ধর্মীয় উৎসব, জনসমাগম এবং প্রতীকী স্থান—সব মিলিয়ে এটি পরিকল্পিত হামলা ছিল কি না, তা নিয়ে তদন্তকারীরা গভীরভাবে কাজ করছেন। অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তা সংস্থাগুলো বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখছে।
ঘটনার পরপরই নিহতদের পরিবারের সদস্যদের শোকাবহ দৃশ্য সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে। বিশেষ করে ১০ বছর বয়সী মাটিল্ডার বাবার মৃত্যু অনেককেই নাড়া দেয়। ছোট একটি শিশুর জীবনে কীভাবে এমন সহিংসতা আজীবনের ক্ষত তৈরি করে দেয়, সেই প্রশ্ন সামনে আসে নতুন করে। শেষকৃত্যানুষ্ঠানে ফুল হাতে মানুষজন যখন নীরবে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তখন বন্ডাই বিচ যেন আর শুধু একটি পর্যটন কেন্দ্র নয়, বরং জাতীয় শোকের প্রতীক হয়ে ওঠে।
তদন্তের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, হামলার কয়েক সপ্তাহ আগে সাজিদ ও নাভিদ আকরামের ফিলিপিন্স সফর। অস্ট্রেলিয়ার ইমিগ্রেশন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, তারা পহেলা নভেম্বর ফিলিপিন্সে পৌঁছান এবং ২৮শে নভেম্বর দেশটি ত্যাগ করেন। সাজিদ সেখানে ভারতীয় পাসপোর্ট ব্যবহার করেছিলেন, আর তার ছেলে ব্যবহার করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ান পরিচয়পত্র। অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং করপোরেশন নিরাপত্তা সূত্রের বরাতে দাবি করেছে, সেখানে তারা ‘সামরিক কায়দায় প্রশিক্ষণ’ নিতে গিয়েছিলেন। যদিও কর্মকর্তারা এই তথ্য এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করেননি।
ফিলিপিন্স সফর নিয়ে সন্দেহ আরও বাড়িয়েছে এই কারণে যে, দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারিয়া থেরেসা লাজারো এবং অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেনি অং পারস্পারিক তথ্য বিনিময়ের বিষয়ে একমত হয়েছেন। দুই দেশের মধ্যে এই কূটনৈতিক যোগাযোগ ইঙ্গিত দেয়, বিষয়টি শুধু একটি বিচ্ছিন্ন হামলা নয়; এর আন্তর্জাতিক যোগসূত্র থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
নাভিদ আকরাম এর আগেও অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তা সংস্থার নজরে এসেছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ জানিয়েছেন, ২০১৯ সালে অন্যদের সঙ্গে সম্ভাব্য যোগসূত্রের ভিত্তিতে নাভিদ প্রথম কর্তৃপক্ষের নজরে আসেন। তবে সেই সময় করা পর্যালোচনায় কোনো তাৎক্ষণিক হুমকি বা সহিংস কার্যক্রমের ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। এই তথ্য সামনে আসার পর প্রশ্ন উঠছে—চরমপন্থার লক্ষণগুলো কি তখন যথাযথভাবে বোঝা যায়নি, নাকি সময়ের সঙ্গে পরিস্থিতি বদলে গেছে?
এই হামলার প্রেক্ষাপটে আবারও আলোচনায় এসেছে বৈশ্বিক চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের প্রসঙ্গ। ইসলামি চরমপন্থি সংগঠন আইএস অতীতে ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশে হামলার দায় স্বীকার করেছে। যদিও বন্ডাই বিচের ঘটনায় এখনো কোনো সংগঠনের সরাসরি দায় স্বীকারের তথ্য নেই, তবু তদন্তকারীরা সব দিক খতিয়ে দেখছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আধুনিক সন্ত্রাসবাদ অনেক সময় একক ব্যক্তি বা ছোট পারিবারিক ইউনিটের মধ্যেই গড়ে ওঠে, যা শনাক্ত করা নিরাপত্তা সংস্থার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষও বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। তেলেঙ্গানা পুলিশের কর্মকর্তারা স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, সাজিদ আকরামের সঙ্গে ভারতের কোনো স্থানীয় উগ্রবাদী নেটওয়ার্কের যোগসূত্র পাওয়া যায়নি। তার বিরুদ্ধে ভারতে কোনো অপরাধের রেকর্ডও নেই। এই বক্তব্য একদিকে যেমন ভারতের ভেতরে দায় চাপানোর প্রবণতা ঠেকাতে সহায়ক, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অভিবাসন ও চরমপন্থার জটিল বাস্তবতাও তুলে ধরে।
এই ঘটনায় অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসন নীতি, গোয়েন্দা নজরদারি এবং সামাজিক সংহতির প্রশ্নও সামনে এসেছে। বহু বছর ধরে অস্ট্রেলিয়া নিজেকে একটি বহুসাংস্কৃতিক, নিরাপদ দেশ হিসেবে তুলে ধরেছে। কিন্তু বন্ডাই বিচের মতো একটি উন্মুক্ত ও জনপ্রিয় স্থানে এমন হামলা সেই আত্মবিশ্বাসে বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে। সাধারণ মানুষ প্রশ্ন করছে—আর কতটা নিরাপদ তারা, আর কীভাবে ভবিষ্যতে এমন হামলা ঠেকানো সম্ভব?
শোকের মধ্যেই চলছে আত্মসমালোচনাও। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু কঠোর আইন বা নজরদারি দিয়ে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র—এই তিন স্তরের মধ্যেই চরমপন্থা প্রতিরোধের কাজ করতে হবে। বিশেষ করে তরুণদের ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতা, পরিচয় সংকট এবং অনলাইন চরমপন্থার প্রভাব কীভাবে কাজ করে, তা নতুন করে বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন রয়েছে।
বন্ডাই বিচের আকাশে এখনো সূর্য ওঠে, ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে তীরে। কিন্তু এই সৈকতের স্মৃতির সঙ্গে এখন যুক্ত হয়ে গেছে রক্ত, কান্না আর নিঃশব্দ শ্রদ্ধা। নিহতদের জন্য জ্বালানো মোমবাতি আর ফুলের তোড়া মনে করিয়ে দেয়, সহিংসতা শুধু মুহূর্তের ঘটনা নয়—এর অভিঘাত দীর্ঘস্থায়ী। অস্ট্রেলিয়া আজ শুধু অপরাধের বিচার নয়, বরং নিজেদের সমাজকে নতুন করে বোঝার এক কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
আপনার মতামত জানানঃ