ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানির সংকটকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক সময়ে যে পরিবর্তিত আঞ্চলিক বাণিজ্যচিত্র গড়ে উঠেছে, তা শুধু দুই দেশের সম্পর্ক নয়, দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক বাস্তবতাকেও নতুনভাবে সামনে এনেছে। একসময় যে বাংলাদেশ ছিল ভারতীয় পেঁয়াজ রপ্তানিকারকদের সবচেয়ে বড়, স্থায়ী এবং লাভজনক বাজার—সেই বাংলাদেশই এখন ধীরে ধীরে ভারতের জন্য ‘হারানো সুযোগ’-এর প্রতীক হয়ে উঠছে। ভারতীয় পেঁয়াজ বাণিজ্য এক সময় যতটা নির্ভরশীল ছিল বাংলাদেশের ওপর, এখন পরিস্থিতি ততটাই উল্টো হয়ে গেছে। দেশটি একদিকে যেমন নিজস্ব উৎপাদন বাড়িয়েছে, অন্যদিকে তেমনই ভারতের বিকল্প হিসেবে পাকিস্তান, চীন কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের নতুন বাজারগুলো থেকে পেঁয়াজ আমদানি করার পথ বেছে নিয়েছে। এই পুরো প্রক্রিয়াটি শুধু দুই দেশের বাণিজ্যনীতির ওঠানামাই বোঝায় না, বরং দেখিয়ে দেয় আঞ্চলিক কৃষি-অর্থনীতিতে সামান্য নীতিগত ভুল কীভাবে স্থায়ী পতনের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
ভারতের রপ্তানিকারকেরা আজ যখন নিজেদের অভূতপূর্ব সংকটের মধ্যে দেখছেন, তখন তাঁরা হতবাক এই ভেবে যে বাজার হারানোর পেছনের প্রধান কারণ তাঁরাই তৈরি করেছেন। বারবার রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা, নীতির অস্থিরতা, হঠাৎ শুল্ক বৃদ্ধি, এবং রাজনৈতিক বা অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতির ওপর ভিত্তি করে রপ্তানিকারকদের হিসাব-নিকাশ পরিবর্তন—এসব মিলিয়ে ভারতীয় পেঁয়াজ বিশ্ববাজারে ‘অবিশ্বস্ত সরবরাহকারী’ হিসেবে পরিচিত হয়েছে। এর সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি লেগেছে বাংলাদেশে। ২০১৯, ২০২০ এবং ২০২৩—এই তিন সময় পেঁয়াজ রপ্তানিতে আকস্মিক নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশে মূল্যবৃদ্ধির ঝড় তুলেছিল। ফলাফলস্বরূপ, বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকেরা বুঝতে পেরেছিলেন—প্রতিবেশীর ওপর একচেটিয়া নির্ভরশীলতা অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিতে পারে। এরই ফলে বাংলাদেশ পাকিস্তান ও চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং একই সঙ্গে নিজেদের কৃষককে প্রণোদনা দেয়, যাতে পেঁয়াজ উৎপাদন বাড়ানো যায়।
এদিকে ভারতের স্থানীয় বাজারে আজ পেঁয়াজের দাম তলানিতে ঠেকেছে, কিন্তু তবুও রপ্তানি স্থবির। বাংলাদেশ আগে যেখানে প্রতি বছর লাখ লাখ টন ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানি করত, সেখানে ২০২৫–২৬ অর্থবছরের মাত্র ছয় মাসে আমদানি হয়েছে মাত্র ১২ হাজার ৯০০ টন—যা প্রায় শূন্যের সামান্য ওপরে। রপ্তানিকারকদের কাছে এটি শুধু আর্থিক ক্ষতির বিষয় নয়; এটি ভারতের দীর্ঘদিনের আধিপত্য হারানোর প্রতীক। কেননা একসময় ভারতীয় পেঁয়াজের গুণগত মান ছিল তুলনাহীন, এবং ক্রেতারা দাম বাড়লেও তা নিতে দ্বিধা করত না। কিন্তু রপ্তানি নিষিদ্ধ হওয়ার দীর্ঘ বিরতির ফলে সেই চাহিদা কমে যায়, আর আমদানিকারক দেশগুলো বিকল্প খুঁজে নেয়। এখন তারা গুণমান নয়, দামের তুলনা করে। ভারতের পেঁয়াজ বাজার তাই আজ প্রতিযোগিতার কঠিন বাস্তবতায় ঠেকে গেছে।
ভারতের রপ্তানিকারকেরা আরেকটি বড় অভিযোগ তুলেছেন—ভারতীয় পেঁয়াজের বীজ নাকি বেআইনিভাবে বাইরে চলে যাচ্ছে এবং প্রতিবেশী দেশগুলো সেই বীজ ব্যবহার করে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে। এতে ভারতের বাজার আরেক ধাপ পিছিয়ে যাচ্ছে। পেঁয়াজের বীজ এমন একটি বিষয়, যা উৎপাদনশীলতা এবং ফলনের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। ভারত দীর্ঘদিন ধরে অঞ্চলে এই বীজের প্রধান উৎস ছিল। কিন্তু যখন সেই বীজই বাংলাদেশের মতো দেশের কৃষককে স্বাবলম্বী বানাতে শুরু করে, তখন ভারতীয় কৃষক ও রপ্তানিকারকেরা নিজেদের অস্তিত্ব সংকটে দেখতে পান। পাশা প্যাটেল কিংবা অজিত শাহ—উভয়েই বলেছেন, নীতিগত বিপর্যয়ের কারণে শুধু বাজারই হারায়নি ভারত; একই সঙ্গে নিজেদের প্রযুক্তিই বাইরে চলে গিয়ে প্রতিযোগী তৈরি করেছে।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি আজ ভিন্ন। দেশটি এখন নিজের উৎপাদন বাড়ানোর নীতি অনুসরণ করছে শুধু বাজার স্থিতিশীলতার জন্য নয়, বরং কৃষক সুরক্ষার জন্যও। কৃষিপণ্যের ওপর হঠাৎ নিষেধাজ্ঞা আরোপ বা রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়া ভারতের অভ্যাস বাংলাদেশের পরিকল্পনাকে বারবার বিঘ্নিত করেছে। ফলে গত দুই বছর ধরে বাংলাদেশ পেঁয়াজ আমদানিতে ভারতকে প্রায় এড়িয়ে গেছে। এর পরিবর্তে পাকিস্তান, চীন, মিয়ানমার—যেখান থেকেই স্থিতিশীল দামে পণ্য পাওয়া সম্ভব, সেখানেই নজর দিয়েছে। এই নীতি কেবল জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলাই করেনি, বরং দেখিয়েছে বিকল্প বাজার গঠনের মাধ্যমে একটি দেশ কীভাবে তার খাদ্য নিরাপত্তাকে আরও স্থায়ী করতে পারে।
এই পুরো প্রেক্ষাপটে ভারতের যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা শুধু বাংলাদেশ বা সৌদি আরবের মতো দেশের পেঁয়াজ আমদানি হ্রাসের কারণে নয়। বরং এটি একটি সমন্বিত সংকট, যেখানে নীতিনির্ধারণ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, কৃষিনির্ভর অর্থনীতি এবং কূটনীতির ভুল সিদ্ধান্ত একত্রে কাজ করেছে। সৌদি আরব, যা একসময় ভারতীয় পেঁয়াজের অন্যতম বড় ক্রেতা ছিল, গত এক বছরে প্রায় কিছুই আমদানি করেনি। তারাও বিকল্প বাজার—বিশেষত ইয়েমেন এবং ইরান—দিকেই ঝুঁকেছে। কারণ পণ্যটি শুধু সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে তাই নয়, সরবরাহও স্থিতিশীল।
ভারতের কৃষি খাতের জন্য এটি বড় সতর্কবার্তা। কারণ দক্ষিণ এশিয়ায় পেঁয়াজের বাজারে একচেটিয়া আধিপত্য দীর্ঘমেয়াদি ছিল। সেই আধিপত্য গড়ে উঠেছিল স্থায়িত্ব, দামের সামঞ্জস্য, মানের ধারাবাহিকতা এবং আঞ্চলিক সম্পর্কের ওপর। কিন্তু বারবার রপ্তানি বন্ধ করা, রাজনৈতিক চাপের কারণে নীতি পরিবর্তন, কিংবা অভ্যন্তরীণ বাজার রক্ষায় অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ এসব বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন করেছে। কৃষিপণ্য এমন এক ক্ষেত্র যেখানে বাজার একবার হাতছাড়া হলে তা ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত কঠিন। কারণ প্রতিটি দেশ তখন নিজস্ব উৎপাদনে বিনিয়োগ বাড়ায়, নতুন প্রযুক্তি নেয়, এবং বিকল্প বাণিজ্যিক সম্পর্ক তৈরি করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটাই হয়েছে।
এই ঘটনার আরেকটি বড় দিক হচ্ছে আঞ্চলিক কৃষি–বাজারে নতুন কেন্দ্র তৈরি হওয়া। চীন বা পাকিস্তান যেমন প্রতিযোগিতামূলক দামে পেঁয়াজ রপ্তানি করছে, তেমনই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পণ্য বিনিময় নতুন বাস্তবতার দিকে এগোচ্ছে। ভারতের কৃষিপণ্য রপ্তানির বহুমাত্রিক সংকট তাই শুধু পেঁয়াজ বাজারেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি ভবিষ্যতের বাণিজ্যনীতির জন্যও এক বড় সতর্কবার্তা। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে বিশ্বাসযোগ্যতা হারালে ব্র্যান্ড–ভ্যালু ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আর সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সময় এবং বিনিয়োগ—দুটিই প্রয়োজন।
বাংলাদেশ আজ যে অবস্থানে পৌঁছেছে, তা কেবল নীতিগত বিচক্ষণতার ফল নয়; বরং এটি দেশের কৃষকদের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার প্রতিফলন। পেঁয়াজ উৎপাদনে গত পাঁচ বছর ধরে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, যা দেশের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করেছে। ভারতের পণ্য অনুপস্থিত থাকায় বাংলাদেশ বিকল্প পণ্য ব্যবস্থাপনায় আরও অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছে। এর ফলে ভারতকে আর অপরিহার্য মনে করা হয় না, যা ভারতের রপ্তানিকারকদের জন্য সবচেয়ে বড় ধাক্কা।
এদিকে ভারতের অভ্যন্তরে পেঁয়াজের দাম পড়ে যাওয়ায় কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কারণ রপ্তানি না হলে স্থানীয় বাজারে সরবরাহ বেড়ে যায়, আর দাম কমে যায়। ফলে কৃষকরা ফসল ধরে রাখতে পারছেন না। এতে ভারতের কৃষি খাতের ওপরও চাপ বাড়ছে। রপ্তানিকারকরা তাই সরকারকে অনুরোধ করছেন—বীজ রপ্তানি বন্ধ করতে, নীতি স্থিতিশীল রাখতে, এবং ক্রেতা দেশগুলোর সঙ্গে পুনরায় সম্পর্ক জোরদার করতে। কিন্তু এটি সহজ নয়। কারণ একবার যখন বাংলাদেশ, সৌদি আরব বা ফিলিপাইনসের মতো দেশ বিকল্প গ্রহণ করে ফেলে, তখন তাদের ফিরিয়ে আনা কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ।
পুরো ঘটনাপ্রবাহটি দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলেছে। বাংলাদেশ—যে দেশ দীর্ঘদিন ভারতের কৃষিপণ্যের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ছিল—এখন তার নিজেদের উৎপাদনশীল ক্ষমতা বাড়িয়েছে। এটি শুধু অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার দিকেই নয়, রাজনৈতিক স্বাধীনতার দিকেও একটি বার্তা বহন করে। বাংলাদেশের কৃষি নীতি এখন আরও সতর্ক, বহুমুখী, এবং আন্তর্জাতিক বাজার–সংবেদনশীল। অন্যদিকে ভারতও বুঝতে শুরু করেছে, প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর প্রভাব বজায় রাখতে হলে কেবল রাজনৈতিক সম্পর্ক নয়, অর্থনৈতিক সম্পর্কেও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে।
শেষ পর্যন্ত এই পুরো পরিস্থিতি একটি বড় শিক্ষা দিয়ে যায়—বাণিজ্য সম্পর্ক কখনোই একতরফা নয়। স্থায়ী সরবরাহ, নীতির স্থিতিশীলতা, এবং আস্থার ভিত্তিতেই আঞ্চলিক কৃষি–বাজার টিকে থাকে। ভারত সেই আস্থা হারিয়েছে। আর বাংলাদেশ সেই সুযোগ ব্যবহার করে নিজেকে নতুন বাস্তবতার জন্য প্রস্তুত করেছে। পেঁয়াজ নিয়ে ভারতের ‘কাঁদা’ কেবল একটি পণ্যের গল্প নয়; এটি বাণিজ্য–নীতির একটি গভীর শিক্ষা, যে শিক্ষা দক্ষিণ এশিয়ার কৃষি–অর্থনীতির ভবিষ্যত গঠনে অনিবার্যভাবে ভূমিকা রাখবে।
আপনার মতামত জানানঃ