চীন–ভারত সীমান্তের পুরোনো দ্বন্দ্ব যেন আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে এক ব্যক্তিগত ভোগান্তির ঘটনার মধ্য দিয়ে। যুক্তরাজ্যে বসবাসরত ভারতীয় নাগরিক প্রেমা ওয়াংজম থংডক, জন্ম অরুণাচল প্রদেশে। কয়েক ঘণ্টার ট্রানজিট নিয়ে জাপান যাওয়ার পথে সাংহাই পুডং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামতেই তাঁর যাত্রাপথ থমকে যায়। অভিযোগ অনুযায়ী, বিমানবন্দরের চীনা কর্মকর্তারা তাঁকে টানা প্রায় ১৮ ঘণ্টা আটকে রাখেন, জেরা করেন, আর একপর্যায়ে জানিয়ে দেন—অরুণাচল প্রদেশ যেহেতু চীনের অংশ, তাই তাঁর ভারতীয় পাসপোর্ট ‘বৈধ’ নয়। ব্যক্তিগত জীবনের এক সাধারণ ট্রানজিট মুহূর্ত পরিণত হয় দুই পরাশক্তি প্রতিবেশীর নতুন রাজনৈতিক উত্তেজনার উৎসে।
থংডকের বক্তব্য অনুযায়ী, তাঁকে আটক করার পর তিনি বারবার জানতে চেয়েছেন কেন এমন আচরণ করা হচ্ছে। উত্তরে কর্মকর্তারা বলেন, অরুণাচল প্রদেশ ‘চীনের অংশ’, ফলে ভারতের দেওয়া পাসপোর্টকে তারা স্বীকৃতি দিচ্ছেন না। শুধু তাই নয়, তাঁকে নাকি চাপ দেওয়া হয় চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইন্সের টিকিট কিনে সেই ফ্লাইটে জাপান যেতে, আর তবেই পাসপোর্ট ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়। দীর্ঘ জেরা, আটকে থাকা, ফ্লাইট মিস হওয়া এবং হোটেলে থাকতে বাধ্য হওয়ায় তাঁর অতিরিক্ত খরচও গুনতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে থাকা এক বন্ধুর সহায়তায় তিনি সাংহাইয়ে ভারতীয় কনস্যুলেটের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন, আর সেখান থেকে কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে অন্য একটি ফ্লাইটে করে সাংহাই ত্যাগ করেন।
দৃষ্টান্তটি কেবল একজন যাত্রীর ব্যক্তিগত ভোগান্তি হিসেবে দেখলে ভুল হবে। কারণ, এর আড়ালে কাজ করছে অরুণাচল প্রদেশকে ঘিরে দীর্ঘ দিনের ভূ–রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, যা এতদিন সীমান্ত সংঘর্ষ, যুদ্ধ, কূটনৈতিক বাক্বিতণ্ডা আর মানচিত্রের টানাপোড়েনেই সীমাবদ্ধ ছিল। এখন সেই দ্বন্দ্ব নাগরিকের পরিচয় ও বৈধ পাসপোর্টের প্রশ্ন পর্যন্ত চলে এসেছে। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসতেই নয়াদিল্লি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায়, আর বেইজিংও তাদের পুরোনো অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে পাল্টা বিবৃতি দেয়। ফলে সম্পর্ক উন্নয়নের সাম্প্রতিক প্রচেষ্টার মাঝেই দুই দেশের সম্পর্ক আবারও অস্বস্তিকর আলোচনায় চলে এসেছে।
অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে চীন–ভারত বিরোধ নতুন কিছু নয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের সিমলা কনভেনশন থেকেই এর বীজ রোপিত। ১৯১৪ সালে তিব্বত, চীন ও ব্রিটিশ ভারতের প্রতিনিধিরা বসেছিলেন সীমানা নির্ধারণে। ব্রিটিশ পক্ষের মধ্যস্থতাকারী হেনরি ম্যাকমোহনের নামে পরিচিত ম্যাকমোহন লাইন তখনই নির্ধারিত হয়, যা আজও আন্তর্জাতিক আলোচনায় ভারতের উত্তর–পূর্ব সীমান্তের প্রধান রেফারেন্স। কিন্তু চীন এই লাইনে কখনোই সই করেনি এবং এটিকে স্বীকৃতি দেয়নি। বেইজিংয়ের যুক্তি ছিল, তিব্বতের কাছে নিজের ভূখণ্ডের সীমানা নির্ধারণের বৈধতা ছিল না, তাই ব্রিটিশ–তিব্বত চুক্তিও তাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য।
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর ভারত ম্যাকমোহন লাইনকে আনুষ্ঠানিক সীমান্ত হিসেবে ধরে নেয়। চীন এদিকে ১৯৫১ সালে তিব্বত দখলের পর সীমান্ত প্রশ্ন আরও নতুন মাত্রা পায়। পুরোনো ব্রিটিশ মানচিত্রের কিছু অংশ তুলে ধরে চীন দাবি করে, ম্যাকমোহন লাইনের দক্ষিণে থাকা বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্রকৃতপক্ষে তাদের ভূখণ্ড। ভারত সে দাবি মানেনি। এই টানাপোড়েনই শেষ পর্যন্ত ১৯৬২ সালের ইন্দো–চীন যুদ্ধের দিকে গড়ায়, যেখানে অরুণাচল প্রদেশের বড় অংশই যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। নামকা চু নদীর দুই তীরে ভারতীয় অবস্থানে আক্রমণ করে চীনা বাহিনী অগ্রসর হয়; তাওয়াং ছাড়তে বাধ্য হয় ভারতীয় সেনারা। যুদ্ধ শেষে চীন যদিও ওই অঞ্চল আবার ভারতকে ফিরিয়ে দেয়, কিন্তু সীমান্ত নিয়ে বিশ্বাসের ফাঁক আর কখনো পূরণ হয়নি।
পরবর্তীকালে ১৯৭৫ সালে তুলুং লা পাসে দুটি দেশের সেনাদের সংঘর্ষে চার ভারতীয় সেনার মৃত্যু হয়, যা লাদাখের সাম্প্রতিক সংঘর্ষের আগ পর্যন্ত ছিল সবচেয়ে প্রাণঘাতী সীমানা–সংঘর্ষ। এরপর বহু বছর অরুণাচল তুলনামূলকভাবে শান্ত থাকলেও ঝড় থেমে ছিল কেবল পৃষ্ঠে। ভেতরে ভেতরে মালিকানা বিতর্ক আরও জটিল হয়েছে। দশকের পর দশক চীন কেবল তাওয়াং অঞ্চলের ওপর দাবি তুললেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পুরো অরুণাচল প্রদেশকেই তারা নিজেদের “দক্ষিণ তিব্বত” বলে দাবি করছে।
এই ভূখণ্ড কেবল মানচিত্রের কয়েকটি আঁকিবুকি নয়; এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে সামরিক, কৌশলগত, জলসম্পদ, এমনকি ধর্মীয়–সাংস্কৃতিক বাস্তবতাও। তাওয়াং অঞ্চল দালাই লামার ঐতিহাসিক ভ্রমণস্থল, আর তিব্বতের প্রশ্নে চীনের সংবেদনশীলতা সুপরিচিত। ফলে অরুণাচলকে নিয়ে যে কোনো কূটনৈতিক পদক্ষেপ বেইজিং জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন হিসেবে দেখায়। অন্যদিকে ভারত বারবার বলে আসছে, অরুণাচল তার অবিচ্ছেদ্য ও অখণ্ড অংশ—এটি ‘অস্বীকার অযোগ্য সত্য’। এর মাঝেই মাঝেমধ্যে দালাই লামার সফর কিংবা ভারতীয় রাজনৈতিক নেতাদের অরুণাচল সফরকে ঘিরে উত্তেজনা তৈরি হয়, যাকে চীন “উস্কানি” হিসেবে চিহ্নিত করে।
সীমান্তের এ বিরোধ শুধু পাহাড়–পর্বত ঘিরে নয়, জলপ্রবাহের দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। তিব্বতের মেডং এলাকায় যেসব বাঁধ নির্মাণ করছে চীন, তার প্রভাব ব্রহ্মপুত্র তথা যমুনা অববাহিকার ওপর পড়ার আশঙ্কা আছে। ভারত এই ঝুঁকি মোকাবিলায় অরুণাচল প্রদেশে জলাধার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর লক্ষ্য একদিকে চীনা বাঁধের প্রভাব নিয়ন্ত্রণ, অন্যদিকে বন্যা প্রতিরোধ। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন—এ জলাধারের কারণে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ছাড়াও বাংলাদেশের অসংখ্য গ্রাম পানিতে তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়তে পারে। সব মিলিয়ে অরুণাচল প্রশ্ন এখন শুধু চীন–ভারতের সীমান্ত রাজনীতি নয়, বরং সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার নদীভিত্তিক নিরাপত্তা ও পরিবেশ ভবিষ্যতের সঙ্গেও জড়িয়ে গেছে।
অরুণাচল প্রদেশ ভারতের সবচেয়ে কম জনবহুল রাজ্য হলেও কৌশলগত দিক থেকে এর গুরুত্ব অপরিসীম। এ অঞ্চল দিয়ে তিব্বত, মিয়ানমারসহ একাধিক দিকের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ আছে, যা সামরিক ও বাণিজ্যিক উভয় ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ। সীমান্তজুড়ে পরিকাঠামো নির্মাণ নিয়ে দুই দেশই প্রতিযোগিতায় নেমেছে—কেউই চাইছে না, অন্য পক্ষ কৌশলগত সুবিধা পেয়ে যাক। ফলে সীমান্তে রাস্তা, সেতু, সামরিক পোস্ট, এয়ারস্ট্রিপ নির্মাণ নিয়ে সন্দেহ আর পাল্টা সন্দেহের রাজনীতিও ঢুকে পড়েছে।
এমন এক প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক দুই–তিন বছরে চীন–ভারত সম্পর্ক খানিকটা প্রশমনের দিকে যাচ্ছিল। লাদাখে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, গালওয়ান উপত্যকার টানটান উত্তেজনা এবং দীর্ঘদিন ধরে চলা সেনা মুখোমুখি অবস্থান দুটি দেশের সম্পর্ককে তলানিতে ঠেলে দিয়েছিল। এরপর নানা পর্যায়ে সামরিক ও কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে সীমান্ত থেকে কিছু সেনা ও অস্ত্র সরিয়ে নেওয়া হয়। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতির চাপ, বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনের সংকট এবং অর্থনৈতিক মন্দার ঝুঁকি ভারত–চীন উভয়কেই কিছুটা বাস্তববাদী অবস্থানে নিয়ে আসে। কাজান শহরে সি চিন পিং ও নরেন্দ্র মোদির বৈঠক, তারপর পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের সফর—সব মিলিয়ে ধারণা করা হচ্ছিল, দুই দেশ অন্তত সম্পর্ক সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ার ঝুঁকি এড়াতে চাইছে।
কিন্তু থংডককে ঘিরে নতুন সংকট দেখাল, পুরোনো দ্বন্দ্ব এখনো অমীমাংসিত এবং সামান্য ঘটনাও সহজেই বড় রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হতে পারে। বেইজিংয়ের বক্তব্য স্পষ্ট: জাংনান (যা তারা অরুণাচলের একটি অংশকে বলে) চীনের ভূখণ্ড, তাই সেখানকার জন্ম নেওয়া কাউকে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে মেনে নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। অন্যদিকে নয়াদিল্লি পুনরায় জোর দিয়ে বলেছে, অরুণাচল ভারতের অন্তর্গত—এ কথা চীন যতই অস্বীকার করুক, বাস্তবতা বদলাবে না। পাশাপাশি তারা অভিযোগ তুলেছে, ট্রানজিট যাত্রীদের ভিসাবিহীন প্রবেশ সুবিধা দেওয়ার নিজেদের ঘোষণাও চীন লঙ্ঘন করেছে।
গবেষকদের মতে, সাম্প্রতিক এই ঘটনা সরাসরি যুদ্ধ বা বড় সংঘর্ষ ডেকে আনবে—এমন আশঙ্কা এখনই নেই। তবে এটি স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিচ্ছে, দুই দেশের মধ্যে “বিশ্বাসঘাটতি” কত গভীর। সীমান্তে গোলাবর্ষণ না হলেও, কূটনৈতিক অঙ্গনে, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে, এমনকি একজন সাধারণ নাগরিকের পাসপোর্ট যাচাইয়ের মুহূর্তেও সেই দ্বন্দ্ব নিজেকে প্রকাশ করছে। এক অর্থে এটি এক ধরনের “আইডেন্টিটি যুদ্ধ”—কোন মানচিত্র সত্য, কার সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত, আর একজন ব্যক্তি কোন রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে সম্মান পাবেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা আরও বলছেন, আন্তর্জাতিক রীতিনীতিকে পাশ কাটিয়ে এমন আচরণ মূলত প্রতীকী বার্তা দেওয়ার কৌশল—চীন দেখাতে চাইছে, অরুণাচল প্রশ্নে তারা তাদের অবস্থান বদলাতে প্রস্তুত নয়। একই সময়ে ভারতও অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে, বিশেষ করে জাতীয়তাবাদী আবেগের ক্ষেত্রেও অরুণাচল নিয়ে কঠোর অবস্থান প্রদর্শনকে গুরুত্ব দেয়। ফলে এই প্রশ্নে কোনও পক্ষই ছাড় দিতে রাজি নয়। কাগজে-কলমে সম্পর্ক উন্নতির কথা বলা হলেও, মাঠের বাস্তবতায় দুটি দেশই একে–অপরকে কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবেই দেখছে।
সবশেষে, অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে এই টানাপোড়েন এ অঞ্চলের ছোট দেশগুলোর জন্যও গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। সীমান্তের ওপারে তৈরি হওয়া বাঁধ, জলাধার, সামরিক পরিকাঠামো—সবকিছুই নদীপ্রবাহ, পরিবেশ, বাণিজ্য ও নিরাপত্তার ওপর বহুমাত্রিক প্রভাব ফেলতে পারে। ভারত–চীনের প্রতিপক্ষতা যত তীব্র হবে, ততই দক্ষিণ এশিয়ার বাকি রাষ্ট্রগুলোকে পানি নিরাপত্তা থেকে শুরু করে পররাষ্ট্রনীতিতে সূক্ষ্ম ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। প্রেমা ওয়াংজম থংডকের মতো একজন সাধারণ যাত্রীর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তাই শেষ পর্যন্ত আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়—একটি সীমান্ত–দ্বন্দ্ব কত দূর পর্যন্ত মানুষের জীবন, পরিচয় এবং ভবিষ্যতের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে, আর পুরোনো অনিষ্পন্ন প্রশ্নগুলো কীভাবে যে কোনো সময় নতুন দ্বন্দ্বের আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ