ম্যানচেস্টারের কুখ্যাত ধর্ষক রেইনহার্ড সিনাগাকে ইন্দোনেশিয়ায় ফেরতের বিনিময়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্রিটিশ নারী লিন্ডসে স্যান্ডিফোর্ডকে মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাব—এটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নৈতিকতা, আইন, কূটনীতি ও মানবাধিকারের জটিল সম্পর্ককে নতুন করে আলোচনায় এনেছে। অনলাইন ডেইলি মেইলের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, কীভাবে এক দেশের ভয়ঙ্কর অপরাধীকে আরেক দেশের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত নাগরিকের বিনিময়ে ফেরত দেওয়ার অদ্ভুত প্রস্তাব ব্রিটিশ কূটনীতিতে অবিশ্বাস, অনিশ্চয়তা ও ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। পুরো ঘটনার কেন্দ্রে রয়েছে দুই ভিন্ন পটভূমির দুই ভিন্ন ধরনের অপরাধী—একজন অমানবিক যৌন অপরাধে দোষী সাব্যস্ত, আরেকজন আন্তর্জাতিক মাদক পাচারের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত।
লিন্ডসে স্যান্ডিফোর্ডের বিষয়ে ব্রিটিশ সরকারের অবস্থান ছিল পরিষ্কার—যে কোনো মুক্তি নিঃশর্ত হতে হবে। কারণ ব্রিটেন কোনোভাবেই এমন বন্দি বিনিময় চুক্তি মেনে নেবে না, যেখানে ১৩৬ জন পুরুষকে ধর্ষণের মতো ভয়াবহ অপরাধে দণ্ডিত একজন দানবীয় অপরাধীর মুক্তির সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। ইন্দোনেশিয়ার প্রস্তাবটি ছিল সরল ভাষায় বলা হলেও নৈতিকতার দিক থেকে বিপজ্জনক। স্যান্ডিফোর্ড ২০১২ সালে ১.৬ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের কোকেন পাচারের দায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। দীর্ঘ ১৩ বছর মৃত্যুদণ্ডের ছায়ায় কাটানোর পর যখন তাঁর মুক্তির সময় ঘনিয়ে এসেছিল, তখনই অদ্ভুতভাবে আলোচনার শর্ত বদলে গেল। ইন্দোনেশিয়া হঠাৎ জানাল—মুক্তি চাইলে বন্দি বিনিময় করতে হবে। খবরটি স্যান্ডিফোর্ডকে যেমন স্তম্ভিত করেছে, তেমনি ব্রিটিশ কূটনীতিকরাও হয়ে পড়েন বিস্মিত ও হতাশ।
এদিকে রেইনহার্ড সিনাগা—যাকে ব্রিটেনের বিচারব্যবস্থা “ব্রিটিশ ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সিরিয়াল রেপিস্ট” হিসেবে চিহ্নিত করেছে—তিনি ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ম্যানচেস্টারের নাইটক্লাব এলাকা থেকে তরুণদের টার্গেট করতেন। নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ডেকে নিয়ে মাদক খাইয়ে অচেতন করে ধর্ষণ করতেন এবং সব ভিডিও ধারণ করতেন। পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর তাঁর ফোনে ছিল ডজন ডজন ভিডিও, যেসব ভিডিও দেখে অনেক ভুক্তভোগী প্রথমবার জানতে পেরেছিলেন যে তারা ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা ১৫৯টি যৌন অপরাধ মামলার মধ্যে ১৩৬টি ছিল ধর্ষণ—যা আধুনিক ব্রিটিশ অপরাধ বিচারব্যবস্থায় এক ভয়াবহ রেকর্ড। আদালত তাঁকে কমপক্ষে ৪০ বছরের কারাদণ্ড দেন, যা বাস্তবে ‘আজীবন কারাবাসের’ সমতুল্য।
এসব বিবেচনায় ব্রিটিশ সরকার স্পষ্ট জানায়, কোনোভাবেই রেইনহার্ড সিনাগাকে ফেরত দেওয়া যাবে না। কারণ সেই প্রক্রিয়া একদিকে যেমন ন্যায়বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে, তেমনি ভুক্তভোগীদের জন্য হবে এক অসহনীয় অন্যায়। ব্রিটিশ সমাজে এই অপরাধ এতটাই নিন্দিত যে কেউ ভাবতেই পারে না—এমন একজন অপরাধী মাত্র পাঁচ বছর কিংবা কয়েক বছরের মধ্যে দেশ পরিবর্তনের অজুহাতে মুক্ত হয়ে যেতে পারে।
তবে গল্পের আরেক দিকও রয়েছে। সিনাগার পরিবার ইন্দোনেশিয়ার প্রভাবশালী এক ধনী পরিবার। তাঁর বাবা বড় ব্যবসায়ী এবং সাবেক ব্যাংকার। ফলে পরিবারটি বহু বছর ধরেই বিভিন্ন উপায়ে চেষ্টা করে আসছে যেন তাকে ইন্দোনেশিয়ায় ফিরিয়ে নেওয়া যায়, যাতে তিনি ‘নিজ দেশে’ সাজা কাটাতে পারেন। তাদের যুক্তি—বিদেশে থাকা অবস্থায় তিনি যথাযথ আইনি ও মানসিক সহায়তা পান না। কিন্তু বাস্তবে এটি মুক্তির দরজা খুলে দিতে পারে এমন আশঙ্কাই ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে আরও সতর্ক ও অনমনীয় করে তুলেছে।
অন্যদিকে স্যান্ডিফোর্ডের অবস্থাও ব্যতিক্রম নয়। মৃত্যুদণ্ডের ছায়ায় এত বছর কাটানোর পর তিনি মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন ব্রিটেনে ফেরত আসার জন্য। এমনকি তিনি নিজের সব জিনিসপত্র সহবন্দিদের দিয়ে দিয়েছিলেন। ঠিক কোন ফ্লাইটে তিনি ফিরবেন, সেটাও জানানো হয়েছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ইন্দোনেশিয়ার সেই অদ্ভুত প্রস্তাব পুরো প্রক্রিয়াকে থামিয়ে দেয় আট দীর্ঘ মাসের জন্য। তাঁর কথায়—“সব প্রস্তুতি হয়ে গিয়েছিল। যাওয়ার আগের দিনই তারা বলল, আমরা বন্দি বিনিময় চাই।” তিনি শুধু অবাক নন; তাঁর কথায় ছিল আতঙ্কও—যদি তাঁকে কেন্দ্র করে এমন একটি চুক্তি বাস্তবায়িত হতো, তাহলে সিনাগার মতো ভয়ঙ্কর অপরাধীর মুক্তির ঝুঁকি তৈরি হতো।
যদিও ইন্দোনেশিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকেও বিষয়টি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ছিল না। দেশটির আইন ও অপরাধবিষয়ক ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে রয়েছে দীর্ঘদিন। তারা তাদের নাগরিককে ফেরত আনার সুযোগ দেখেছিল এবং মনে করেছিল, ব্রিটেন হয়তো মানবিকতা বা কূটনৈতিক সমঝোতার ভিত্তিতে শর্তটি মানতে পারে। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার সে পথে হাঁটেনি। তাদের অবস্থান ছিল অত্যন্ত কঠোর—বিচারের ন্যায়বোধকে তারা কোনো দিক দিয়েই ক্ষুণ্ন করতে চায়নি।
স্যান্ডিফোর্ডের মুক্তির পর এখন অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন—এই ঘটনা ভবিষ্যতের আন্তর্জাতিক বন্দি বিনিময় নীতিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলবে? বহু দেশে মৃত্যুদণ্ড রয়েছে, আর বহু দেশে তা নেই। এক দেশে অপরাধীর মুক্তি অন্য দেশে অবিশ্বাস, ন্যায়বিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কিংবা কূটনৈতিক সম্পর্কের উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হলো, শুধু রাজনৈতিক আলোচনা বা অর্থনৈতিক সম্পর্কই বন্দি বিনিময়ের ক্ষেত্রে শেষ কথা নয়; ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, সামাজিক অনুভূতি এবং ভুক্তভোগীদের মর্যাদার বিষয়ও এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
রেইনহার্ড সিনাগা ব্রিটেনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যৌন অপরাধীদের একজন হিসেবে চিহ্নিত, আর লিন্ডসে স্যান্ডিফোর্ড ছিলেন আন্তর্জাতিক মাদক পাচারে জরিত একজন নারী—দুই অপরাধীর প্রকৃতি ভিন্ন হলেও তাদের নাম একসঙ্গে আলোচনায় আসার কারণে অপরাধবিচার ও কূটনীতি এক নতুন দ্বন্দ্বের মুখে দাঁড়িয়েছে। ব্রিটিশ সরকারের অবস্থান নিঃসন্দেহে দেখিয়েছে—বড় কোনো কূটনৈতিক সম্পর্কের বিনিময়েও তারা এমন চুক্তি করবে না, যা ন্যায়বিচারকে বিকৃত করে দিতে পারে।
শেষ পর্যন্ত স্যান্ডিফোর্ড দেশে ফিরেছেন এবং সিনাগা ব্রিটেনেই থাকছেন—কঠোর নিরাপত্তায়, কঠিন কারাবন্দি জীবন নিয়ে। তবে এই ঘটনাটি মনে করিয়ে দিল, আন্তর্জাতিক অপরাধ এবং বিচারব্যবস্থার জগৎ শুধু আইনের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে না; দেশগুলোর রাজনৈতিক হিসাব, নৈতিক অবস্থান, জনমতের চাপ, এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জটিলতা সবকিছুই সেখানে গভীরভাবে কাজ করে। এই জটিল সম্পর্কই কখনো কখনো জন্ম দেয় এমন অদ্ভুত ও অস্বস্তিকর প্রস্তাবের, যার ভেতরে লুকিয়ে থাকে মানবিকতা, চাকচিক্যহীন বাস্তবতা এবং কখনো কখনো গভীর নৈতিক প্রশ্ন।
আপনার মতামত জানানঃ