
বাংলাদেশের রাজনীতিতে যদি জামায়াতে ইসলাম ক্ষমতায় আসে, তাহলে দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক প্রভাব পড়বে—এটা এখন আলোচনার অন্যতম প্রধান বিষয়। দীর্ঘ সময় নিষিদ্ধ থাকা দলটি সাম্প্রতিক সময়ে আবার সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে, এবং সেই সম্ভাবনা নিয়ে সমাজে যেমন আগ্রহ, তেমনি উদ্বেগও বেড়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে ধর্মনিরপেক্ষ নীতিতে চললেও, জামায়াতের ক্ষমতায় আসা মানে রাজনীতির ধারায় এক বড় পরিবর্তন। এই পরিবর্তন যেমন নতুন চিন্তার দ্বার খুলতে পারে, তেমনি তা আবার দেশের সামাজিক ও কূটনৈতিক কাঠামোতে গভীর সমস্যার জন্মও দিতে পারে।
প্রথমত, দেশের অভ্যন্তরীণ সমাজব্যবস্থা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হতে পারে। বাংলাদেশের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষ নীতিকে স্বীকৃতি দিলেও জামায়াতে ইসলামী অতীতে এই নীতির বিরোধিতা করে এসেছে। তাদের রাজনৈতিক দর্শন ধর্মকেন্দ্রিক এবং ইসলামিক শাসনব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে। যদি তারা ক্ষমতায় আসে, তাহলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়—বিশেষ করে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান নাগরিকদের নিরাপত্তা প্রশ্নে নতুন করে সংকট দেখা দিতে পারে। কারণ এই দলটির অতীত ইতিহাসে দেখা গেছে, তারা ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করেছে। রাষ্ট্রীয় নীতিতে ধর্মের প্রভাব বেড়ে গেলে নারী অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় একধরনের চাপ তৈরি হবে। যদি রাষ্ট্র পরিচালনায় ইসলামিক আইন প্রয়োগের প্রবণতা দেখা যায়, তাহলে পাঠ্যক্রম, শিক্ষক নিয়োগ ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও ধর্মীয় প্রভাব বাড়বে। এতে শিক্ষা হবে সীমাবদ্ধ ও অভিন্ন; বিজ্ঞান, দর্শন বা আধুনিক জ্ঞানচর্চা ব্যাহত হবে। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে স্বাধীনতা কমে গিয়ে রাজনৈতিক আনুগত্য ও ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে পদায়ন বাড়তে পারে। বিচারব্যবস্থায় নিরপেক্ষতার জায়গায় ধর্মীয় ব্যাখ্যার প্রভাব বাড়লে রাষ্ট্রের মৌলিক ন্যায়বিচার ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যাবে।
অর্থনীতিতেও এর প্রভাব পড়বে। জামায়াতে ইসলামী যদি কঠোরভাবে ধর্মীয় নীতিতে চলে, তবে বৈদেশিক বিনিয়োগ ও আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যে আস্থা কমে যাবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সাধারণত স্থিতিশীল ও উদার পরিবেশে কাজ করতে চান, যেখানে আইনের শাসন ও ব্যবসায়িক স্বাধীনতা থাকে। কিন্তু ধর্মীয় রাষ্ট্রনীতি আরোপিত হলে সেই আস্থা নষ্ট হতে পারে। বিশেষ করে নারী কর্মসংস্থান, পোশাকশিল্প বা বিদেশি ব্যাংকগুলোর কার্যক্রমে বাধা আসতে পারে। এতে দেশের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়বে, তরুণ প্রজন্মের কর্মসংস্থান কমে যাবে, এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও পতন ঘটবে।
আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়বে। জামায়াতে ইসলামী অতীতে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন আছে। যদি তারা ক্ষমতায় আসে, তাহলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নরম হওয়ার বদলে আরও জটিল হতে পারে। ভারত সবসময় ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশকেই তার স্থিতিশীল প্রতিবেশী হিসেবে দেখতে চায়। অন্যদিকে, পশ্চিমা দেশগুলো—যেমন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন—মানবাধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে জোর দেয়। যদি জামায়াতের শাসনে এসব মূল্যবোধ ক্ষুণ্ণ হয়, তাহলে বাংলাদেশ তাদের সাহায্য, বাণিজ্যিক সুবিধা ও উন্নয়ন সহায়তা হারাতে পারে।
আরও বড় বিষয় হলো, দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতায় বাংলাদেশের ভূমিকা দুর্বল হতে পারে। জামায়াতে ইসলামী অতীতে আন্তর্জাতিকভাবে একাধিক উগ্র সংগঠনের সঙ্গে আদর্শিক সম্পর্ক রাখার অভিযোগে সমালোচিত হয়েছে। তারা যদি সরকার পরিচালনায় আসে, তাহলে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি “উগ্রবাদপন্থী রাষ্ট্র” হিসেবে উপস্থাপিত হতে পারে। এর ফলে জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতো সংস্থাগুলো বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতা কমিয়ে দিতে পারে। একই সঙ্গে বিদেশি পর্যটক, শিক্ষার্থী ও বিনিয়োগকারীদের আগ্রহও কমে যেতে পারে।
অন্যদিকে, এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি আরও বিভক্ত হবে। জামায়াতের আদর্শের বিপরীতে অবস্থান নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলো—বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও বামঘরানার দলগুলো—তীব্র বিরোধিতায় নামবে। এর ফলে রাজনীতিতে সংঘাত, সহিংসতা ও প্রতিশোধের সংস্কৃতি ফিরে আসবে। গণতান্ত্রিক পরিবেশ দুর্বল হবে, নির্বাচনের প্রতি মানুষের আস্থা হারাবে। যদি বিরোধী দলগুলো রাস্তায় নামে, তাহলে দেশ আবার রাজনৈতিক অস্থিরতায় জড়িয়ে পড়বে।
তবে একদিক থেকে এটিকে সুযোগ হিসেবেও দেখা যায়। যদি জামায়াতে ইসলামী তার অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নেয় এবং ইসলামের নৈতিকতা বজায় রেখে মানবাধিকার, শিক্ষা, নারী উন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায়ের পথে চলে, তাহলে তারা একটি নতুন রাজনৈতিক অধ্যায় শুরু করতে পারে। কিন্তু তাদের অতীত ইতিহাস বিবেচনায় এই সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। তারা যদি কঠোর ধর্মীয় নীতিতে রাষ্ট্র চালায়, তাহলে জনগণের স্বাধীনতা ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্য টিকবে না।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো—বাংলাদেশ কি ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে মেনে নিতে প্রস্তুত? স্বাধীনতার মূল চেতনা ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবিক মূল্যবোধ। জামায়াতে ইসলামী যদি সেই ভিত্তিকে পরিবর্তন করতে চায়, তাহলে রাষ্ট্রের আদর্শগত পরিচয়ই পরিবর্তিত হয়ে যাবে। একদিকে হয়তো তারা বলবে তারা ইসলামিক কল্যাণ রাষ্ট্র গড়তে চায়, কিন্তু বাস্তবে তার মানে হতে পারে—রাষ্ট্রে ভিন্ন মতের দমন, মুক্ত গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ এবং নারীর অংশগ্রহণ সীমিত করা।
দীর্ঘমেয়াদে এসব পরিবর্তন বাংলাদেশের সমাজকে দুই ভাগে ভাগ করে দিতে পারে—একটি অংশ ধর্মীয় জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী, অন্যটি উদার গণতন্ত্রে। এই বিভাজন শুধু রাজনীতিতেই নয়, পরিবার, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতেও প্রভাব ফেলবে। মুক্তচিন্তা, শিল্প, সাহিত্য—সবক্ষেত্রে আত্মনিয়ন্ত্রণের বৃত্ত তৈরি হবে। রাষ্ট্র যদি নাগরিকের চেয়ে ধর্মীয় পরিচয়কে বড় করে দেখে, তাহলে মানুষ তার পরিচয় হারাতে শুরু করবে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কেও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে। উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলো সাধারণত মানবাধিকার ও ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর গুরুত্ব দেয়। তারা হয়তো বাংলাদেশকে সন্দেহের চোখে দেখবে, সাহায্য কমাবে বা শর্ত বাড়াবে। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞাও আসতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ হয়তো সমর্থন দেবে, কিন্তু তাতে অর্থনৈতিক ভারসাম্য আসবে না। কারণ বাংলাদেশ যে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ওপর নির্ভরশীল—বিশেষত রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ে—তা মূলত পশ্চিমা দেশ ও উদার সমাজের ওপর নির্ভর করে।
অতএব, জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশ এক নতুন বাস্তবতায় প্রবেশ করবে। এটি হতে পারে রাজনৈতিকভাবে তীব্র, সামাজিকভাবে বিভক্ত ও আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন এক সময়। কিন্তু একই সঙ্গে এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের স্থায়িত্বেরও পরীক্ষা হবে। জনগণ যদি সত্যিই মুক্তচিন্তা ও ন্যায়ের পক্ষে থাকে, তাহলে তারা যেকোনো একমুখী শক্তির প্রভাব থেকে দেশকে রক্ষা করবে। কিন্তু যদি ভয় ও বিভ্রান্তি প্রভাব বিস্তার করে, তাহলে বাংলাদেশ হয়তো তার সেই মুক্তি ও বৈচিত্র্যের পথ হারাবে, যেটি একাত্তরে রক্ত দিয়ে অর্জিত হয়েছিল।
আপনার মতামত জানানঃ