পায়রা বন্দর বাংলাদেশের পটুয়াখালী জেলায় অবস্থিত বাংলাদেশের তৃতীয় এবং দক্ষিণ এশিয়ার একটি সামুদ্রিক বন্দর। ২০১৩ সালের ১৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টিয়াখালী ইউনিয়নের ইটবাড়িয়া গ্রামে এর ভিত্তিফলক উন্মোচন করেন। সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়নাধীন সরকারের ১০টি ফার্স্ট ট্র্যাক প্রকল্পের একটি হওয়া সত্ত্বেও এটিকে পড়তে হচ্ছে নানা জটিলতায়। পায়রা বন্দর স্থাপনে চলমান দুটি প্রকল্পের মধ্যে একটির সময় ও ব্যয় বেড়েছে এবং অন্যটির বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে।
উল্লিখিত প্রকল্প দুটি হলো- ‘পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দরের কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো/সুবিধাদির উন্নয়ন (প্রথম সংশোধিত)’ এবং ‘পায়রা সমুদ্রবন্দরের প্রথম টার্মিনাল এবং আনুষঙ্গিক সুবিধাদি নির্মাণ’ প্রকল্প। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে দুটি প্রকল্পই বাস্তবায়ন করছে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ।
জানা গেছে, ‘পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দরের কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো/সুবিধাদির উন্নয়ন (প্রথম সংশোধিত)’ প্রকল্পটি ২০১৫ সালের জুলাইয়ে শুরু হয়ে শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৮ সালের জুনে। সেই সময়ের পর আড়াই বছরের বেশি অতিক্রান্ত হলেও এটির কাজ শেষ হয়নি। কয়েক দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে সর্বশেষ ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত এর সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রথমবার ঠিক করা মেয়াদের পর এ পর্যন্ত সময় বেড়েছে চার বছর। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, প্রকল্পটির এখন পর্যন্ত কাজ হয়েছে ৭২ শতাংশ (বাস্তব অগ্রগতি)।
কেবল সময়ই নয়, প্রকল্পটির ব্যয়ও বেড়েছে তিনগুণ। পায়রা বন্দরের অবকাঠামো নির্মাণে এ প্রকল্পের মূল খরচ ছিল ১১ কোটি ২৮ লাখ ৪৩ হাজার টাকা, যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ কোটি ৫০ লাখ ৫১ হাজার টাকায়। এখন পর্যন্ত টাকা খরচ হয়েছে মোট বরাদ্দের ৬২ শতাংশ (আর্থিক অগ্রগতি)।
অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পের পর ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে শুরু হয় ‘পায়রা সমুদ্রবন্দরের প্রথম টার্মিনাল এবং আনুষঙ্গিক সুবিধাদি নির্মাণকাজ। মূল উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) অনুসারে এটি শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২১ সালের ডিসেম্বরে। সে হিসেবে শেষ হওয়ার আর মাত্র পাঁচ মাস বাকি থাকলেও এখন পর্যন্ত অগ্রগতি ৯ শতাংশ মাত্র। ফলে এর মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। বর্তমানে এ প্রকল্পের মোট খরচ ধরা হয়েছে তিন হাজার ৯৮২ কোটি ১০ লাখ টাকা। এখন তা বাড়িয়ে করা হচ্ছে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। এ প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব আগামী জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পেতে পারে।
প্রকল্পের মেয়াদ ও সময় বাড়ানোর বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক ও পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের উপ-প্রধান প্রকৌশলী মো. নাসির উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) সংশোধনের জন্য পাঠিয়েছি। একনেকে আগামী সপ্তাহে অনুমোদন হওয়ার কথা রয়েছে। সংশোধনীতে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের সময় বাড়ানোর আবেদন করা হয়েছে। দেড় বছরের মতো সময় বাড়ানো হচ্ছে। আমাদের ডিজাইন, ড্রইং যখন করা হয়েছে তখন জেটি, ইয়ার্ড, ব্রিজ এই উপাদানগুলোর মধ্যে ব্রিজে, ডিজাইনে টাকা বেড়েছে। এটার টেন্ডার এখনো আমরা করিনি। সড়ক ও মহাসড়ক এটার টেন্ডার করবে। এতে ৪০০ কোটি টাকার মতো বাড়বে। প্রকল্পের মোট খরচ এখন সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে।’
প্রকল্পের অগ্রগতির তথ্য তুলে ধরে নাসির উদ্দিন বলেন, ‘দুটার কাজ চলছে। একটার চুক্তি হয়েছে ২০২০ সালের জুনে, আরেকটার জুলাইয়ে। সেই হিসাবে কাজের অগ্রগতি ভালো। চাইনিজরা আসছে, কাজ শুরু করছে। একটার পাঁচ মাস, আরেকটার ছয় মাস শেষ হয়েছে। এই সময়ে জেটি নির্মাণ অগ্রগতি ১২ শতাংশ, ইয়ার্ড নির্মাণের অগ্রগতি সাড়ে ১০ শতাংশ। এই দুটিরই আর্থিক অগ্রগতি ১০ শতাংশ।’
পরিকল্পনার দুর্বলতা স্বীকার করেও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশের যেকোনো প্রকল্পের নির্মাণ সময় ও ব্যয় বাড়ার পেছনে এক অসাধু শ্রেণির কারসাজিও জড়িত থাকে। নির্মাণ সময় ও ব্যয় বাড়িয়ে অর্থ বগলদাবার কৌশল আঁটা হয় প্রকল্পগুলোতে। এছাড়া অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি আর অনিয়মও রয়েছে এসবের পেছনে।
নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ল সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের ১৯ নভেসম্বর দেশের তৃতীয় সমুদ্রবন্দর হিসাবে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে পায়রা সমুদ্র বন্দর। স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনায় পায়রা সমুদ্র বন্দরের উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে। স্বল্প মেয়াদী পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে বহিঃনোঙ্গরে ক্লিংকার, সার ও অন্যান্য বাল্ক পণ্যবাহী জাহাজ আনয়ন ও লাইটার জাহাজের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরে পরিবহণ করা।
মধ্যমেয়াদী পরিকল্পনায় রয়েছে ১০ মিটার গভীরতার চ্যানেল ড্রেজিং, একটি কন্টেইনার, একটি মাল্টিপারপাস ও একটি বাল্ক টার্মিনালসহ বন্দর অবকাঠামো তৈরি করে বন্দর কাযক্রম শুরু করা।
আন্তর্জাতিক মানের দেশীয় ও আঞ্চলিক বন্দর সুবিধা সৃষ্টির মাধ্যমে পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর স্থাপনের জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসাবে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত আছে ঢাকা থেকে পায়রা বন্দর পর্যন্ত রেল লাইন নির্মাণ, একটি এলএনজি টার্মিনাল, একটি লিকুইড বাল্ক টার্মিনাল নির্মাণ, জাহাজ ও রক্ষণাবেক্ষণ সুবিধা সংবলিত ডকইয়ার্ড নির্মাণ, বিমানবন্দর নির্মাণ, কুয়াকাটা কেন্দ্রিক পর্যটন ও রফতানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকা স্থাপন।
স্বল্প ও মধ্যমেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য নির্মাণ সামগ্রী ও অন্যান্য বাল্ক পণ্যবাহী জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করে দেশের অভ্যন্তরে প্রয়োজনীয় স্থানে পরিবহণ সহজতর করার জন্য অর্থাৎ আক্ষরিক অর্থে পায়রা বন্দরের বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরুর জন্য কন্টেইনার টার্মিনাল, মাল্টিপারপাস টার্মিনালসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহ ও অবকাঠামো নির্মাণের জন্য মূল প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়।
মূল প্রকল্পের আওতাধীন পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দরের কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো/সুবিধাদির উন্নয়ন (প্রথম সংশোধিত)’ এবং ‘পায়রা সমুদ্রবন্দরের প্রথম টার্মিনাল এবং আনুষঙ্গিক সুবিধাদি নির্মাণ’ প্রকল্প—দুটি প্রকল্পই নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বাস্তবায়ন করছে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ। নানা জটিলতার মুখে পড়েছে প্রকল্প দুটির ভূমি অধিগ্রহণ, পরামর্শক ও ঠিকাদার নিয়োগ। ফলে ভুগছে প্রকল্পটি দুটি।
এসডব্লিউ/জেএন/কেএইচ/১৫০০
আপনার মতামত জানানঃ