দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ভূমি ও গৃহহীন পরিবার ঘর পেলে তা তাদের জন্য কতটা ইতিবাচক ও উপকারী তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মুজিববর্ষে ভূমিহীন-গৃহহীন সব অসহায় মানুষকে নতুন ঘর উপহার দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিয়েছেন, তার আওতায় এসব ঘর বিতরণ করা হয়। এটা সত্য সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প যারা বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এখানেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।
নানা ধরনের অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় নির্মিত ঘর ভেঙে পড়ছে বলে বিভিন্ন জায়গা থেকে খবর আসে। কোথাও অল্প বৈরী আবহাওয়াতে ভেঙে পড়ছে, কোথাওবা এমনি এমনিতেই। এদিকে শরীয়তপুরের গোসাইরহাটে আশ্রয়ণ প্রকল্প-২–এর নির্মাণাধীন ঘর ভাঙচুর চালিয়েছে কে বা কারা যেন। গতকাল বুধবার রাতে গোসাইরহাট উপজেলার সামন্তসার এলাকায় নির্মাণাধীন ১৫টি ঘরের খুঁটি ও দেয়াল ভেঙে ফেলে দেয়া হয়। ১২ থেকে ১৫ সদস্যের দুর্বৃত্তদের একটি দল এ কাজ করেছে বলে জানায় উপজেলা প্রশাসন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনিয়ম আর দুর্নীতি ঢাকতেই এই ভাংচুর চালিয়েছে।
উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, যাদের জমি ও বসতঘর নেই, এমন ব্যক্তিদের আশ্রয়ণ প্রকল্প-২–এর অধীনে সামন্তসার এলাকায় খাস জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়। তাদের জন্য ৩২টি ঘর নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। সম্প্রতি ঘরগুলোর খুটি ও দেয়ালের গাঁথুনি করা হয়েছে।
সামন্তসার ইউনিয়ন পরিষদের চৌকিদার ও প্রকল্প এলাকার নিরাপত্তা কর্মী মো. আবুল কালাম সরদার গণমাধ্যমকে বলেন, বুধবার সন্ধ্যার পর ১২ থেকে ১৫ জন লোক এসে ঘরগুলো ভাঙতে থাকে। তিনি টের পেয়ে চিৎকার করেন। তখন তারা প্রকল্প এলাকা থেকে দ্রুত দৌড়ে পালিয়ে যায়। অন্ধকার থাকায় হামলাকারীদের কাউকে চিনতে পারেননি।
বৃহস্পতিবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আলমগীর হোসাইন, শরীয়তপুরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আব্দুর রহিম ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা তাহমিনা আক্তার চৌধুরী।
প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা তাহমিনা আক্তার চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, ক শ্রেণিভুক্ত প্রকল্পের আওতায় ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা ব্যয়ে দুই কক্ষবিশিষ্ট ঘর ও একটি বারান্দা এবং একটি শৌচাগার নির্মাণ করা হচ্ছে। গত সোমবার নির্মাণাধীন ঘরের পিলার ও দেয়াল গাঁথুনি করা হয়েছে। এখনো সিমেন্ট জমাট বাঁধার মতো সময় পার হয়নি। গাঁথুনি করার এক দিনের মাথায় এই হামলার ঘটনা ঘটায় পিলার ও দেয়ালের কিছু অংশ ভেঙে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত অংশ ভেঙে পুনরায় নির্মাণ করা হবে।
ইউএনও আলমগীর হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া প্রকল্পের নাগেরপারা ইউনিয়নের ৩২টি ঘরের মধ্যে ১৫টি ঘরের পিলারসহ কিছু অংশ ভেঙে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। সন্ধ্যার পরে রাতে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটায় হামলাকারীদের শনাক্ত করা যায়নি। দ্রুত সময়ের মধ্যে হামলাকারীদের শনাক্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার প্রস্তুতি চলছে।
দুই শতাংশ খাস জমিসহ প্রদান করা দুই কক্ষবিশিষ্ট আধাপাকা বাড়ি নিয়ে অভিযোগ উঠে বিভিন্ন অনিয়ম ও অবহেলার। এরই পরিপ্রেক্ষিতে করোনা মহামারির কঠোর বিধিনিষেধের মাঝেও দেশব্যাপী আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাড়ি পরিদর্শনে নেমেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একাধিক টিম। টিমের পর্যবেক্ষণেও উঠে আসছে বিভিন্ন স্থানের অনিয়মে নির্মিত ঘরের দুরাবস্থার কথা। বিশ্লেষকরা তাই বলছেন, অনিয়ম আর দুর্নীতি ঢাকতেই এই ভাংচুর।
এর আগেও সাবেক ইউএনওর দুর্নীতি ঢাকতে আশ্রয়ণ প্রকল্পের সাতটি ঘর রাতের আঁধারে ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার বর্তমান ইউএনও। প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ঘর নির্মাণের নানা ত্রুটি নিয়ে দুর্নীতির তদন্ত শুরু হয়। সদ্য বিদায়ী ইউএনও মৌসুমি জেরিনকে রক্ষা করতেই এই ঘর ভাঙা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা। উপজেলার লাঙ্গলঝাড়া ইউনিয়নের তৈলকুপি গ্রামে ঘরগুলো ভাঙা হয়।
এর আগেও সাবেক ইউএনওর দুর্নীতি ঢাকতে আশ্রয়ণ প্রকল্পের সাতটি ঘর রাতের আঁধারে ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার বর্তমান ইউএনও। প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ঘর নির্মাণের নানা ত্রুটি নিয়ে দুর্নীতির তদন্ত শুরু হয়। সদ্য বিদায়ী ইউএনও মৌসুমি জেরিনকে রক্ষা করতেই এই ঘর ভাঙা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।
লাঙ্গলঝাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য শরিফুল ইসলাম বলেন, রাতের আঁধারে অনেক লোকজন ভেকু মেশিন দিয়ে ঘর ভাঙা শুরু করে। ট্রাকে করে ঘরের ইট ও অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে যায় তারা। জানালা-দরজাগুলো অন্য একটি ঘরের মধ্যে রাখা হয়। সেদিন ইউএনওর কাছে জানতে চাইলাম কী হচ্ছে এসব? তখন বললেন, এসব ঘরে লোকজনকে থাকতে দিলে প্রাণহানির ভয় আছে। তাই ঘরগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
স্থানীয়রা জানায়, খুবই নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে ঘরগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ প্রকল্পের পরিদর্শক দল আসার খবরে ঘরগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে।
খুলনার কয়রা উপজেলায় আবারো প্রধানমন্ত্রীর উপহারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণে ব্যাপক দুর্নীতি, অনিয়ম ও অর্থের লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। এ অভিযোগ খোদ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি)সহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেই।
এর আগেও গৃহহীনদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর উপহার ৫০টি ঘর নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগের তথ্য পাওয়া গেছে। প্রশাসনসহ ঊর্ধ্বতন মহলের নীরবতায় কয়রায় দুর্নীতির ধারা অব্যাহত রয়েছে বলে অভিযোগ সচেতন মহলের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গৃহহীন ও ভূমিহীনদের জন্য সরকারের প্রকল্পটি এভাবে দুর্নীতির শিকার হবে ভাবতেও কষ্ট হয়। জনপ্রতিনিধিসহ সম্পৃক্ত স্থানীয় প্রশাসন আন্তরিক থাকলে এসব ঘর উদ্বোধনের সাথে সাথে ধসে পড়ার কথা নয়। দুঃখজনক হলো— সংশ্লিষ্টদের লোভের সীমা সর্বগ্রাসী হওয়ায় এখন নিঃস্বদের দেয়া সরকারের উপহারের মধ্যে ভাগ বসানো হচ্ছে।
তারা বলেন, উপহারের ঘরগুলো আবার টেকসই করে নির্মাণ করে দেয়া উচিত। যাদের কাছ থেকে ঘুষ নেয়া হয়েছে; সেই অর্থ তাদের ফিরিয়ে দিতে হবে। আর যারা দুর্নীতি করেছেন তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দুস্থদের জন্য বরাদ্দ করা সুবিধা দুর্নীতিবাজদের কবল থেকে রক্ষা পায়।
বলেন, সরকারি প্রতিটি প্রকল্পের কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও পিছিয়ে পড়াদের উন্নয়নে সরকারের প্রকল্পগুলোতে যদি বারবার অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা চিত্র ফুটে ওঠে, তা অত্যন্ত লজ্জাজনক। আশ্রয়ণ প্রকল্পের অনিয়ম ও দুর্নীতি যদি বন্ধ করা না যায়, তা হলে এই প্রকল্পের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য মাঠে মারা যাবে এবং দুর্নীতিবাজরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে। আমাদের প্রত্যাশা, সরকার আশ্রয়ণ প্রকল্পের অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে এবং অভিযুক্ত সরকারি কর্মকর্তাদের কেবল ওএসডি করা নয়, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
বস্তুত হতদরিদ্রদের জন্য গৃহনির্মাণ প্রকল্পে সব ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়ম রোধের বিষয়টিকে অধিক গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা উচিত। ‘গরিবের হক’ বলে একটি কথা চালু আছে। সেই হক নিয়ে ‘নয়ছয়’ হবে কিংবা সেখানে বিত্তবানরা ভাগ বসাবে- এটা হতে পারে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২৩৪১
আপনার মতামত জানানঃ