চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের বাণিজ্য প্রবাহের প্রাণকেন্দ্র। দেশের মোট আমদানি-রপ্তানির ৯২ শতাংশ এবং কনটেইনার ওঠানামার ৯৮ শতাংশই এই বন্দর দিয়ে সম্পন্ন হয়। সাম্প্রতিক সময়ে এই বন্দর ঘিরে নতুন করে উত্তপ্ত বিতর্ক দেখা দিয়েছে। কারণ, সরকার একদিকে বিদেশি কোম্পানির হাতে টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব দিতে যাচ্ছে, অন্যদিকে বন্দর ব্যবহারের ট্যারিফ বা মাশুল ৪১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছে। ব্যবসায়ী মহল, অর্থনীতিবিদ ও শ্রমিকদের একাংশ এই সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করছে। তারা বলছেন, বিদেশি কোম্পানিকে সুবিধা দিতে এবং তাদের লাভ নিশ্চিত করতেই এই ট্যারিফ বাড়ানো হয়েছে। সরকার অবশ্য দাবি করছে, এ দুটি সিদ্ধান্তের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই, বরং বন্দর আধুনিকায়ন ও আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার লক্ষ্যেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালটি ইতোমধ্যে চালু রয়েছে এবং সেটির পরিচালনার দায়িত্ব সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পাশাপাশি কর্ণফুলী নদীর তীরে লালদিয়ার চরে নতুন একটি টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার সুযোগ পাচ্ছে ডেনিশ কোম্পানি এপি মোলার মায়ার্স (এপিএম)। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ডিসেম্বরের মধ্যেই চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং এটি হবে ২৫ থেকে ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তি। সরকার বলছে, বন্দর পরিচালনায় বৈশ্বিক মানের কোম্পানি আসলে নতুন বিনিয়োগ বাড়বে, প্রযুক্তি ও দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে, এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের অবস্থান আরও শক্ত হবে।
কিন্তু ব্যবসায়ীরা এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নন। চট্টগ্রাম পোর্ট ইউজার্স ফোরামের আহ্বায়ক আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বন্দরের বর্তমান ট্যারিফ কাঠামোতেও বছরে দুই হাজার কোটি টাকার বেশি মুনাফা হয়। সেক্ষেত্রে ৪১ শতাংশ ট্যারিফ বাড়ানো অযৌক্তিক। তার অভিযোগ, সরকার বিদেশি কোম্পানিকে বাড়তি লাভের সুযোগ দিতে এই পদক্ষেপ নিয়েছে। একই সুরে ব্যবসায়ী নেতা আমিরুল হক বলেন, “বিদেশি কোম্পানিকে আকৃষ্ট করার জন্য ট্যারিফ বাড়ানো গর্হিত কাজ। দক্ষতা বাড়াতে হবে, কিন্তু ব্যবসার খরচও কমাতে হবে।”
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ এই সিদ্ধান্তের নৈতিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেন, “মাশুল বৃদ্ধির একটি চেইন ইফেক্ট আছে—এর ফলে আমদানি পণ্যের দাম বাড়বে, রপ্তানি খরচ বাড়বে, ফলে মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে। এই সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ী উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।” তিনি মনে করেন, সরকার বিদেশি কোম্পানির স্বার্থে কাজ করছে, যা দেশের স্বার্থের পরিপন্থী।
অন্যদিকে, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক দাবি করেন, ট্যারিফ পুনর্বিন্যাসের প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১৯ সালে, অনেক আগে থেকেই। ১৯৮৬ সালের পর থেকে এই ট্যারিফ কাঠামো পরিবর্তন হয়নি, তাই নতুন করে সংশোধন করা হয়েছে। তার ভাষায়, “এই ট্যারিফ বাড়ানো বিদেশি অপারেটরের জন্য নয়, বরং বন্দর পরিচালনার বাস্তব চাহিদার কারণে।” তবে ব্যবসায়ীরা পাল্টা যুক্তি দিচ্ছেন, ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যবৃদ্ধির কারণে সরকার ইতিমধ্যেই বড় অঙ্কের লাভ করছে, তাই ট্যারিফ বৃদ্ধির যৌক্তিকতা নেই।
বিদেশি কোম্পানির হাতে টার্মিনাল পরিচালনার সিদ্ধান্ত ঘিরে শ্রমিক ও স্থানীয় অংশীদারদের মধ্যেও অসন্তোষ ছড়িয়েছে। তারা মনে করছেন, লাভজনক একটি চালু টার্মিনাল বিনা দরপত্রে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়া দেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। যদিও বন্দর সচিব জানিয়েছেন, “এটি কোনো বিক্রি নয়, বরং আন্তর্জাতিক অপারেটরদের সঙ্গে অংশীদারিত্বমূলক চুক্তি। তারা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পরিচালনা করবে এবং পরবর্তীতে সেটি সরকারের কাছে ফেরত দেবে।”
চট্টগ্রাম বন্দরের প্রাক্তন প্রশাসন ও পরিকল্পনা সদস্য মো. জাফর আলম জানিয়েছেন, বিদেশি অপারেটর নিয়োগের ধারণাটি নতুন নয়। ২০১৭-১৮ সালের দিকে ডিপি ওয়ার্ল্ড সরকারকে একটি প্রস্তাব দিয়েছিল, যাতে তারা শুধু এনসিটি পরিচালনা নয়, বরং রেল সংযোগ ও ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপোর উন্নয়নেও বিনিয়োগ করতে চেয়েছিল। তার মতে, “বন্দর তখনই দক্ষ হবে যখন এর পশ্চাদভূমির সঙ্গে ডেডিকেটেড সংযোগ তৈরি হবে।” তবে তিনি সতর্ক করে দেন, “এনসিটির মতো ইতোমধ্যে বিনিয়োগকৃত টার্মিনাল বিদেশিদের দিলে হিসাব-নিকাশে ভুল হলে ক্ষতি হতে পারে।”
বিদেশি অপারেটরদের পক্ষে সরকার যে যুক্তি দিচ্ছে—বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য এটি অপরিহার্য—তা অনেক বিশেষজ্ঞই প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, “বন্দর অদক্ষ নয়; সময় বেশি লাগে কাস্টমস, প্রশাসনিক জটিলতা ও দুর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে। অপারেটর বদলালে এগুলোর কিছুই পরিবর্তন হবে না।” তিনি চারটি কারণ তুলে ধরেন কেন জাতীয় প্রতিষ্ঠানকেই এই দায়িত্ব দেওয়া উচিত: প্রথমত, ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান বিবেচনায় বিদেশি প্রভাব ঝুঁকিপূর্ণ; দ্বিতীয়ত, বন্দর লাভজনকভাবে চলছে; তৃতীয়ত, জাতীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরিচালিত হলে দেশীয় সক্ষমতা বাড়ে; এবং চতুর্থত, রপ্তানিকারক ও অর্থনীতির প্রতিযোগিতা সক্ষমতা টিকে থাকে।
অন্যদিকে, ব্যবসায়ী নেতারা টার্মিনাল প্রাইভেট অপারেটরদের কাছে দেওয়ার পক্ষে থাকলেও স্বচ্ছতা চান। আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “সরকার যদি বিদেশিদের আনতে চায় তবে টেন্ডার আহ্বান করে আনুক। এতে প্রতিযোগিতা বাড়বে, ভালো প্রস্তাব পাওয়া যাবে।” তিনি অভিযোগ করেন, “যেভাবে ৪১ শতাংশ ট্যারিফ বাড়ানো হয়েছে, তা আসলে বিদেশি অপারেটরের লাভ নিশ্চিত করার জন্য। এতে দেশের ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।”
সরকার অবশ্য ভিন্নমত পোষণ করে বলছে, বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান আসলে বন্দরের আধুনিকীকরণ ও বিনিয়োগ বাড়বে। কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, সরকার সমালোচনার জায়গা রাখছে না, সিদ্ধান্ত নিচ্ছে একতরফাভাবে। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ মন্তব্য করেন, “সরকারের এই মনোভাব স্বৈরাচারী। শেখ হাসিনা টেন্ডার ছাড়াই ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এখন অন্তর্বর্তী সরকারও একই পথে হাঁটছে কেন, সেটি প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।”
চট্টগ্রাম বন্দরের আধুনিকায়ন অবশ্য সময়ের দাবি। বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিং ২০৩০ সালের মধ্যে পাঁচ মিলিয়নে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে। এই সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে প্রযুক্তি ও বিনিয়োগ জরুরি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই বিনিয়োগ দেশের নিয়ন্ত্রণে থেকে সম্ভব কি না। সমালোচকরা বলছেন, বিদেশি কোম্পানি আসলে দেশীয় দক্ষতা ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অথচ বন্দর বিকাশে জাতীয় নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি।
সবশেষে বিষয়টি দাঁড়িয়েছে জাতীয় স্বার্থ বনাম বৈশ্বিক বিনিয়োগ আকর্ষণের বিতর্কে। সরকার যেখানে আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বকে উন্নয়নের উপায় হিসেবে দেখছে, সেখানে ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের একাংশ এটিকে অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বের হুমকি হিসেবে দেখছেন। এই বিতর্কের মূলে রয়েছে একটি মৌলিক প্রশ্ন—বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর কি বিশ্বমানের দক্ষতায় উন্নীত হবে, নাকি বিদেশি স্বার্থে পরিচালিত একটি কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে? চট্টগ্রাম বন্দরের ভবিষ্যৎ এই প্রশ্নের উত্তরেই নির্ভর করছে।
আপনার মতামত জানানঃ