বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে নব্বইয়ের দশকের শুরুটা ছিল এক পরিবর্তনের সময়। পুরনো ধারার সিনেমা তখন দর্শক টানতে পারছিল না, নায়ক-নায়িকাদের অভিনয়ে ছিল ক্লান্তি, গল্পে ছিল একঘেয়েমি। ঠিক তখনই যেন হঠাৎ আকাশ ভেদ করে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো হাজির হন সালমান শাহ। ১৯৯৩ সালে ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ দিয়ে তার যাত্রা শুরু, আর প্রথম ছবিতেই যেন দর্শক পেয়ে গেলেন নতুন প্রজন্মের এক প্রতীক। স্টাইল, পোশাক, কথা বলার ধরন, চুলের কাটিং—সবকিছুতে তিনি আলাদা। বাংলা চলচ্চিত্রে আগে কেউ এমন আধুনিক ও আত্মবিশ্বাসী ছিলেন না। সালমান শাহ যেন সিনেমার পর্দা থেকে নেমে আসা কোনো বাস্তব নায়ক, যে প্রেম করে, কাঁদে, বিদ্রোহ করে—সবকিছুই যেন তরুণদের জীবনের সঙ্গে মিলে যায়।
সালমানের জনপ্রিয়তা ছিল অবিশ্বাস্য। সিনেমা হলে তার ছবি মুক্তি মানে উৎসবের আমেজ। শহর থেকে গ্রাম—সব জায়গায় তরুণ-তরুণীরা তার মতো পোশাক পরতে শুরু করে। তার চুলের ধরন অনুকরণ করতে নাপিতদের দোকানে লাইন লেগে যেত। কেউ কেউ তার সংলাপ মুখস্থ করে বলত, কেউ আবার চিঠি লিখে জানাত ভালোবাসা। বলা যায়, তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রকৃত অর্থে ‘স্টাইল আইকন’। তার মধ্যে একাধারে রোমান্স, সাহস, আর আধুনিকতার ছোঁয়া ছিল। তিনি ছিলেন সেই সময়ের প্রতিটি তরুণের আত্মপরিচয়ের অংশ।
কিন্তু এই উজ্জ্বল নক্ষত্রের জীবন থেমে যায় অকালে। ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সকালে খবর আসে—সালমান শাহ আর নেই। ইস্কাটনের বাসায় ঘরের সিলিং ফ্যানে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায় তার নিথর দেহ। খবরটি মুহূর্তের মধ্যেই দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশে। কেউ বিশ্বাস করতে পারছিল না, এমন প্রাণবন্ত একজন মানুষ আত্মহত্যা করতে পারেন। চলচ্চিত্র পাড়া, সংবাদমাধ্যম, সাধারণ মানুষ—সবাই হতবাক। তার পরিবার প্রথম থেকেই বলেছিল, এটি আত্মহত্যা নয়, পরিকল্পিত হত্যা।
তখনকার তদন্তে ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু পরিবারের আপত্তি থেকেই যায়। তারা বারবার বলেছে, সালমান মানসিকভাবে দুর্বল ছিলেন না, বরং তিনি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে খুবই আশাবাদী ছিলেন। তাছাড়া, মৃত্যুর আগের দিন রাতেও তিনি সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেছেন, নতুন সিনেমার শিডিউল ঠিক করেছেন। একজন মানুষ যদি আত্মহত্যা করতে চান, তাহলে কি এমনভাবে কাজের পরিকল্পনা করেন?
এমন সন্দেহ থেকেই বছর কেটে গেলেও পরিবার ন্যায়বিচারের দাবি ছাড়েনি। অবশেষে ২০২৫ সালের অক্টোবরে আদালত মামলাটিকে অপমৃত্যু থেকে হত্যা মামলায় রূপান্তরের নির্দেশ দেয়। এ খবর যেন আবারও নাড়া দেয় গোটা দেশকে। নতুন করে আলোচনায় আসে সেই পুরনো জবানবন্দি, যা ১৯৯৭ সালে দিয়েছিলেন আসামি রেজভী। তার ভাষায়, “আমরা সালমান শাহকে হত্যা করেছি, তারপর ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে সাজানো হয়েছে।” রেজভীর বক্তব্য অনুযায়ী, সালমানকে হত্যার পেছনে ছিল ১২ লাখ টাকার চুক্তি, যা করেছিলেন সালমানের শাশুড়ি লতিফা হক লুসি। এতে নাকি যুক্ত ছিলেন সালমানের স্ত্রী সামিরা হক, কিছু সিনেমার খলনায়ক ও কয়েকজন পেশাদার ভাড়াটে। পরিকল্পনা হয় গুলিস্তানের একটি বারে, যেখানে টাকার অঙ্ক, অস্ত্র আর কৌশল ঠিক করা হয়। রেজভীর মতে, সেই রাতেই তারা সালমানের বাসায় ঢোকে এবং ঘুমন্ত অবস্থায় ক্লোরোফর্ম দিয়ে তাকে অচেতন করে। পরে ইনজেকশন দিয়ে হত্যা করা হয়, এরপর সিলিং ফ্যানে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় লাশ, যাতে দেখে মনে হয় আত্মহত্যা।
ঘটনার বর্ণনা শুনলে গা শিউরে ওঠে। এতদিন ধরে এই জবানবন্দি নাকি উপেক্ষিত ছিল। এখন আবার আদালতের নির্দেশে নতুন তদন্ত শুরু হয়েছে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মামলার সব আসামির বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। তদন্ত পুনরায় শুরু হবে, এবং আশা করা হচ্ছে, এবার হয়তো সত্যটা বেরিয়ে আসবে।
সালমান শাহর মৃত্যু শুধু একটি ব্যক্তিগত বা পারিবারিক ঘটনা ছিল না; এটি পুরো একটি প্রজন্মের মানসিকতায় গভীর আঘাত হেনেছিল। নব্বইয়ের দশকে যেসব তরুণ-তরুণী বড় হচ্ছিল, তাদের কাছে সালমান ছিলেন রোল মডেল। তিনি শেখালেন, কিভাবে সাহসী হতে হয়, কিভাবে নিজের স্বপ্নের পেছনে ছুটতে হয়। তার মৃত্যু যেন সেই স্বপ্নে বজ্রাঘাতের মতো পড়ে। দেশে আত্মহত্যার ঘটনা বাড়তে থাকে, অনেকে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। বলা হয়, সেই সময় তার মৃত্যুর খবর শুনে কয়েকজন ভক্তও আত্মহত্যা করেছিলেন। এটা কেবল এক নায়কের মৃত্যু ছিল না, এটি ছিল এক সময়ের আবেগ, প্রেম, ও জীবনের বিশ্বাসের ভাঙন।
বাংলা সিনেমা সালমান শাহর মৃত্যুর পর থেকে যেন আর আগের জায়গায় ফিরে যেতে পারেনি। তার পরের প্রজন্মের নায়কদের মধ্যে কেউ কেউ জনপ্রিয় হয়েছেন, কিন্তু কেউই সেই “সালমান-ম্যাজিক” তৈরি করতে পারেননি। তিনি যেভাবে সিনেমাকে আধুনিকতার ছোঁয়া দিয়েছিলেন—চেহারায়, পোশাকে, অভিনয়ে, সংলাপে—সেটি তার মৃত্যুর পর যেন হারিয়ে যায়। চলচ্চিত্র শিল্প আবারও বাণিজ্যিক কাঁচামালে পরিণত হয়, যেখানে শিল্পের চেয়ে বাজার বড় হয়ে ওঠে।
এদিকে সালমানের মৃত্যু সমাজের এক অদ্ভুত দিকও প্রকাশ করে। মানুষ উপলব্ধি করে, খ্যাতির পেছনে লুকিয়ে থাকতে পারে ঈর্ষা, ষড়যন্ত্র, আর ক্ষমতার খেলা। তখন থেকেই আমাদের বিনোদন জগৎ আর নিরাপদ মনে হয়নি। ভক্তরা বুঝে যায়, তারকারাও মানুষ—তাদের হাসির আড়ালে থাকে ব্যথা, ভয় আর রাজনীতি।
কেন তাকে হত্যা করা হতে পারে—এই প্রশ্নের উত্তরে নানা বিশ্লেষণ রয়েছে। কেউ বলেন, পেশাগত ঈর্ষা থেকে, কেউ বলেন পারিবারিক দ্বন্দ্বে। কেউ আবার দাবি করেন, তার বিয়েকে কেন্দ্র করেই বিরোধ তৈরি হয়। সালমান ছিলেন জনপ্রিয়, তরুণীদের আইডল। তার প্রেম, বিয়ে ও ব্যক্তিগত জীবনও ছিল আলোচনার কেন্দ্র। অনেকেই মনে করেন, এই জনপ্রিয়তা, ঈর্ষা আর জটিল সম্পর্কই তার মৃত্যুর মূল কারণ।
তবে একটি বিষয় স্পষ্ট—সালমান শাহকে হারিয়ে বাংলা চলচ্চিত্র এমন এক শূন্যতার মুখে পড়ে, যা আজও পূরণ হয়নি। তিনি ছিলেন এমন এক অভিনেতা, যিনি একসাথে ছিলেন বুদ্ধিদীপ্ত, রোমান্টিক ও বিদ্রোহী। তিনি প্রমাণ করেছিলেন, নায়ক মানেই শুধু মারামারি নয়—নায়ক মানে অনুভূতি, আত্মবিশ্বাস আর ভালোবাসা।
তার মৃত্যু প্রমাণ করে, একটি সমাজ কীভাবে তার নায়ককে বাঁচাতে ব্যর্থ হয়। আজ প্রজন্ম বদলেছে, কিন্তু সালমান শাহ এখনো অমর। তার ছবিগুলো এখনো দেখা হয় ইউটিউবে, তার সংলাপ এখনো তরুণদের ভালোবাসার প্রকাশ। ২৯ বছর পরও মানুষ যখন নতুন করে তদন্তের খবর শোনে, তখন আবারও বুক কেঁপে ওঠে। কারণ, সালমান শাহ শুধুই এক অভিনেতা নন—তিনি এক সময়ের প্রতীক, এক তরুণ বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।
আজও যদি কেউ প্রশ্ন করে—বাংলা সিনেমার সবচেয়ে বড় তারকা কে? উত্তর আসে নিঃসংকোচে—সালমান শাহ। কারণ তিনি ছিলেন এমন এক আলো, যা নেভে না; সময় শুধু তার চারপাশে ধুলো জমায়, কিন্তু আলোর দীপ্তি কখনো ম্লান হয় না।
আপনার মতামত জানানঃ