দেশের বিভিন্ন জায়গায় একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সরকার উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, চট্টগ্রামের ইপিজেড এবং মিরপুরসহ বিভিন্ন স্থানে আগুন লাগার পর বিষয়টি এখন জাতীয় পর্যায়ের আলোচনায় এসেছে। এসব ঘটনার পেছনের কারণ জানতে এবং ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা রোধে সরকার একটি উচ্চপর্যায়ের কোর কমিটি গঠন করেছে। ১২ সদস্যের এই কমিটির প্রধান করা হয়েছে স্বরাষ্ট্রসচিব নাসিমুল গণিকে।
রোববার বিকেলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি), র্যাব ও বিজিবির প্রধান, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রতিনিধিরা। বৈঠক শেষে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম সাংবাদিকদের জানান, শাহজালাল বিমানবন্দর ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে সম্প্রতি যেসব অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে, সেগুলোর সবকটিই এই কমিটি তদন্ত করবে। তদন্ত শেষে তারা একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন জমা দেবে, আর সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এখনও পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না এসব ঘটনা নাশকতা নাকি দুর্ঘটনা। উপদেষ্টা বলেছেন, তদন্ত প্রতিবেদন না পাওয়া পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব নয়। তিনি আরও জানান, কমিটি আগামী ৫ই নভেম্বর আবার বৈঠক করবে এবং তার আগেই তদন্তের প্রাথমিক প্রতিবেদন পাওয়া যাবে।
গত কয়েক সপ্তাহে অগ্নিকাণ্ডের যেসব ঘটনা দেশজুড়ে ঘটেছে, তা শুধু দুর্ঘটনা নয়—বরং এক ধরনের সতর্কবার্তা হিসেবেও দেখা হচ্ছে। বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে বড় ধরনের আগুন লেগেছিল, যেটি নিয়ন্ত্রণে আনতে দীর্ঘ সময় লেগেছে। সেখানে বিমানবন্দরের নিজস্ব ফায়ার সার্ভিস থাকলেও আগুন নেভানোর মতো পর্যাপ্ত সরঞ্জাম বা প্রশিক্ষণ ছিল না বলে জানা গেছে। এর আগে চট্টগ্রামের ইপিজেডে আগুন লেগে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়। আর মিরপুরের রূপনগরে পোশাক কারখানা ও রাসায়নিক গুদামে অগ্নিকাণ্ডে ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।
এই ঘটনাগুলোর পর বিশ্লেষকরা বলছেন, একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের পেছনে প্রশাসনিক গাফিলতি, প্রযুক্তিগত দুর্বলতা এবং অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অনেক ভবনে পর্যাপ্ত অগ্নি নিরোধক ব্যবস্থা নেই, ফায়ার অ্যালার্ম কাজ করে না, আর কর্মীরা প্রশিক্ষিত নয়। বিমানবন্দরের মতো সংবেদনশীল জায়গায়ও যদি দ্রুত পদক্ষেপ নিতে এতটা সময় লাগে, তাহলে অন্য জায়গার অবস্থা অনুমান করা যায়।
সরকার বলছে, এই কমিটির মাধ্যমে সব ঘটনার একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যাবে। কোথায় ঘাটতি, কার অবহেলা, কিংবা কোথায় নিরাপত্তা ঝুঁকি আছে—সবকিছুই এই তদন্তে উঠে আসবে। প্রয়োজনে ভবন, গুদাম ও শিল্প প্রতিষ্ঠানে অগ্নি নিরাপত্তা নীতিমালা আরও কঠোর করা হবে। বিমানবন্দর, ইপিজেড, এবং শিল্পাঞ্চলগুলোতে নিয়মিত পরিদর্শন চালানো হবে এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কারিগরি উন্নয়ন আনা হবে।
ফায়ার সার্ভিসের একাধিক কর্মকর্তার মতে, দেশে শিল্প স্থাপনার সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে, তার তুলনায় ফায়ার সার্ভিসের জনবল, সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণ অনেক কম। অনেক এলাকায় ফায়ার স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছাতে সময় লাগে, ফলে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শুধু প্রশাসনিক তদন্ত নয়, ভবিষ্যতের জন্য একটি প্রযুক্তিনির্ভর আগুন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তৈরি করা জরুরি।
এদিকে, বিমানবন্দরের মতো স্থানে আগুন লাগা জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। কারণ, এটি শুধু একটি স্থাপনা নয়—দেশের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও নিরাপত্তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যদি সেখানে অগ্নি নিরাপত্তা দুর্বল হয়, তাহলে বড় বিপর্যয় ঘটতে পারে। একইভাবে ইপিজেডে আগুন লাগা দেশের রপ্তানি খাতের জন্যও বড় ধাক্কা। পোশাক ও শিল্পখাতে অগ্নিকাণ্ড মানে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, হাজারো শ্রমিকের জীবন ও জীবিকা হুমকিতে পড়া।
তদন্তে যদি দেখা যায় এসব ঘটনা পরিকল্পিত বা নাশকতামূলক, তাহলে সরকার আইনগতভাবে কঠোর ব্যবস্থা নেবে বলে জানিয়েছে। আবার যদি দেখা যায় অবহেলা, প্রশিক্ষণের অভাব বা কারিগরি দুর্বলতা দায়ী, তাহলেও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সাধারণ মানুষের মধ্যে এখন এক ধরনের আশঙ্কা কাজ করছে। একের পর এক বড় অগ্নিকাণ্ড দেখে অনেকে ভাবছেন, দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো কতটা নিরাপদ? কর্মক্ষেত্রে কাজ করা মানুষরা কতটা সুরক্ষিত? মানুষ এখন চায় সরকার শুধু কমিটি গঠনেই থেমে না থেকে বাস্তব পরিবর্তন ঘটাক—নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী হোক, নিয়মিত পরিদর্শন হোক, এবং দুর্ঘটনা ঘটলে দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাতে সক্ষম হোক।
এই ঘটনাগুলো থেকে শিক্ষা নেওয়া এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ, যদি প্রতিবার আগুনের পর শুধু তদন্ত কমিটি গঠিত হয় আর বাস্তবে কোনো উন্নতি না হয়, তাহলে একই ঘটনা আবার ঘটবে। সরকারের উচিত হবে এই প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা এবং বিমানবন্দর থেকে শুরু করে সব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাকে নিরাপদ করা। আগুন নেভানোর চেয়ে আগুন প্রতিরোধের প্রস্তুতি অনেক বেশি কার্যকর—এই উপলব্ধিটাই এখন জাতীয় পর্যায়ে বাস্তবায়ন করতে হবে।
সবশেষে বলা যায়, আগুনের এই ধারাবাহিকতা বাংলাদেশের জন্য এক নতুন সংকেত। এখন সরকারের হাতে সুযোগ আছে এর থেকে শিক্ষা নিয়ে একটি নিরাপদ ও দায়িত্বশীল ব্যবস্থা গড়ে তোলার। অগ্নিকাণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদন শুধু দায় নির্ধারণের জন্য নয়, বরং ভবিষ্যতের পথ দেখানোর জন্য হওয়া উচিত। এই প্রতিবেদন থেকেই বেরিয়ে আসবে দেশের অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রকৃত চিত্র—যা অনুযায়ী কাজ করলে হয়তো আমরা এমন দুঃসহ অগ্নিকাণ্ড থেকে অনেকটা মুক্তি পেতে পারব।
আপনার মতামত জানানঃ