গাজায় দুই বছরের ভয়াবহ যুদ্ধের পর যখন যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসে, তখন ইসরায়েলের রাস্তায় আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়। যারা হামাসের হাতে বন্দী হয়েছিল, তাদের পরিবার তেল আবিবে নেমে আসে, কেউ কেঁদে ফেলেন, কেউ পতাকা উড়িয়ে উদ্যাপন করেন। মনে হচ্ছিল, দীর্ঘ এক চাপা কষ্টের অবসান ঘটেছে। তবে, এই আনন্দের মাঝেও ইসরায়েলি সমাজে দেখা দিয়েছে এক অদ্ভুত বিভাজন—যুদ্ধ সমর্থক ও যুদ্ধবিরোধীদের মধ্যে ফাটলটা এখন আরও স্পষ্ট।
অনেকেই মনে করছেন, এই যুদ্ধ ইসরায়েলি সমাজকে ভেতর থেকে ভেঙে দিয়েছে। যারা গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করছেন, তারা এখন সংখ্যালঘু হয়ে গেছেন। সমাজে তাদেরকে প্রায় একঘরে করে ফেলা হয়েছে। অন্যদিকে, যারা যুদ্ধকে সমর্থন করছিলেন, তারা আন্তর্জাতিক মহলের নিন্দায় ক্ষুব্ধ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যখন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, তখন যুদ্ধপন্থীরা মনে করছে, তাদের দেশকে অন্যায়ভাবে দোষারোপ করা হচ্ছে।
ইসরায়েলের বিশ্লেষক নিম্রোড ফ্ল্যাশেনবার্গ বার্লিন থেকে বলেছেন, যুদ্ধবিরতির খবর শুনে তিনি কেঁদে ফেলেছিলেন। তার মতে, এটি শুধু একটি রাজনৈতিক চুক্তি নয়—এটি মানুষের দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ থেকে মুক্তির এক মুহূর্ত। অনেক ইসরায়েলির কাছে এটি একপ্রকার স্বস্তি ও আশার প্রতীক। তবে সবাই এতটা আশাবাদী নয়। কেউ কেউ মনে করেন, চুক্তিটি ভঙ্গ হওয়ার আশঙ্কা এখনও রয়ে গেছে।
বামপন্থী সংসদ সদস্য আইদা তোউমা-সুলেইমান বলেছেন, দুই বছর ধরে তারা যুদ্ধবিরতির জন্য আহ্বান জানাচ্ছিলেন। তাই আজকের আনন্দ তাদের কাছে অমূল্য। কিন্তু একইসাথে তিনি সতর্ক করেছেন—এই সরকারকে মানুষ বিশ্বাস করে না। কারণ, অতীতে নেতানিয়াহু একাধিকবার যুদ্ধ বন্ধে অনীহা দেখিয়েছেন। মানুষ আশঙ্কা করছে, কেউ না কেউ আবার সংঘাত শুরু করার অজুহাত খুঁজে বের করবে।
এই সন্দেহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি নিজের রাজনৈতিক স্বার্থে যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করেছিলেন। তার জোটে থাকা অতি-ডানপন্থী দলগুলো যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিল। বিরোধীরা মনে করে, নেতানিয়াহু বন্দীদের মুক্তির চেয়ে নিজের রাজনৈতিক অবস্থান টিকিয়ে রাখাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও একসময় এমন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, নেতানিয়াহু যুদ্ধ শেষ করতে চান না, কারণ এতে তার ক্ষমতা টলে যেতে পারে।
এখন যুদ্ধবিরতি হলেও নেতানিয়াহুর সংকট শেষ হয়নি। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা ঝুলছে, ৭ অক্টোবরের হামলার আগে নিরাপত্তা ব্যর্থতা নিয়ে তদন্ত চলছে, আর তার জোটের মধ্যে সামরিক নিয়োগ নিয়ে অতি-অর্থোডক্স গোষ্ঠীর সঙ্গে তীব্র দ্বন্দ্ব। গাজায় যুদ্ধ চলার সময় এসব ইস্যু আড়ালে ছিল, কিন্তু এখন যুদ্ধ বন্ধ হলে সেগুলো আবার সামনে আসবে।
তবে নেতানিয়াহু এখন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাওয়া কিছু “সাফল্য” তুলে ধরতে পারেন। তিনি দাবি করতে পারেন, হামাসকে দুর্বল করেছেন, বন্দীদের ফিরিয়ে এনেছেন, হেজবুল্লাহর নেতৃত্বকে নির্মূল করেছেন, এমনকি ইরান ও সিরিয়ার প্রভাব কমিয়ে এনেছেন। এই যুক্তি ব্যবহার করে তিনি আসন্ন নির্বাচনে সমর্থন জোগাড়ের চেষ্টা করবেন।
অন্যদিকে, তার ডানপন্থী মন্ত্রিসভার অনেকেই এই চুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোত্রিচ এবং জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-গভির যুদ্ধবিরতির বিরোধিতা করেছেন এবং সরকার ছাড়ার হুমকি দিয়েছেন। কিন্তু বিরোধী দলগুলো চুক্তিকে সমর্থন দেওয়ায় তাদের পক্ষে কতদূর যাওয়া সম্ভব হবে তা অনিশ্চিত।
ইসরায়েলি জনমনে আরেকটি বড় প্রশ্ন হলো—এই যুদ্ধবিরতির কৃতিত্ব কার? নেতানিয়াহু, নাকি ডোনাল্ড ট্রাম্প? কারণ যুক্তরাষ্ট্র, বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসন, এই চুক্তি বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়া গাজার যুদ্ধ সম্ভবই হতো না। ব্রাউন ইউনিভার্সিটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের মূল অর্থায়নকারী ছিল যুক্তরাষ্ট্র।
কিন্তু কাতারে হামাস নেতাদের ওপর ইসরায়েলের ব্যর্থ হামলার পর এবং আরব রাষ্ট্রগুলোর ঐক্যবদ্ধ প্রতিক্রিয়ায় পরিস্থিতি বদলে যায়। তখন মার্কিন প্রশাসন তাদের অগ্রাধিকার পরিবর্তন করে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ট্রাম্পই নেতানিয়াহুকে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হতে বাধ্য করেছেন। ইসরায়েলি বিশ্লেষক ফ্ল্যাশেনবার্গ বলেন, “ট্রাম্প, তুরস্ক ও কাতারের মতো মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে একত্র হয়ে ইসরায়েলকে চাপে ফেলেছেন। আসলে এই চুক্তি আরও আগেই সম্ভব ছিল, কিন্তু ট্রাম্পই এটিকে শেষমেশ বাস্তবায়ন করেছেন।”
এখন অনেকেই মনে করছেন, ট্রাম্পের এই সক্রিয় ভূমিকা ভবিষ্যতে ইসরায়েল-আমেরিকা সম্পর্কের ধরনকেও বদলে দিতে পারে। কারণ, ট্রাম্প প্রচলিত নিয়ম মানেন না। তিনি নিজের সিদ্ধান্তে চলেন, এবং প্রয়োজনে বন্ধু দেশকেও চাপ দিতে দ্বিধা করেন না। বিশ্লেষক মিচেল বারাক বলেন, “ট্রাম্পের জন্য নিয়ম বা ঐতিহ্যের কোনো মানে নেই। তিনি নিজের খেলায় নতুন নিয়ম তৈরি করেন।”
এই প্রেক্ষাপটে নেতানিয়াহুর অবস্থান বেশ জটিল। একদিকে তিনি যুদ্ধবিরতিকে নিজের সাফল্য হিসেবে তুলে ধরতে চান, অন্যদিকে তার জোটের অনেক সদস্য এই চুক্তির বিরোধিতা করছে। যুদ্ধবিরতির আলোচনায় যুক্ত থাকা মার্কিন বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ ও ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনারের সম্পৃক্ততা চুক্তিটিকে আরও রাজনৈতিক করেছে। ফলে এখন ইসরায়েল চাইলেও সহজে এই প্রক্রিয়া থেকে সরে আসতে পারবে না।
তবে ভবিষ্যত এখনো অনিশ্চিত। চুক্তির প্রথম ধাপ শেষ হলেও দ্বিতীয় ধাপ কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, তা কেউ জানে না। যুদ্ধবিরতি কি স্থায়ী শান্তিতে রূপ নেবে, নাকি আবার রক্তপাত শুরু হবে—এই প্রশ্নই এখন ইসরায়েলি সমাজকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
যুদ্ধ শেষ হলেও গাজা ও ইসরায়েলের মানুষদের মনে ভয় ও অবিশ্বাস রয়ে গেছে। গাজায় শিশুরা জাতীয় পতাকা জড়িয়ে আনন্দ করছে, কিন্তু তাদের চোখে যুদ্ধের ছাপ এখনো স্পষ্ট। আর ইসরায়েলে মানুষ যেন আনন্দের মাঝেও আতঙ্কে ডুবে আছে—যেন এই শান্তি অস্থায়ী, আর একদিন হঠাৎ করেই আবার বোমা পড়বে।
যুদ্ধবিরতির পরও ইসরায়েলি রাজনীতি এখন দোলাচলে। নেতানিয়াহু হয়তো দাবি করবেন, তিনি মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের অবস্থান শক্ত করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তার সরকার ভেতর থেকে বিভক্ত, সমাজ বিভক্ত, আর জনগণের আস্থা ক্রমেই ক্ষয়ে যাচ্ছে। যদি ট্রাম্প সত্যিই ইসরায়েলকে চাপ দিয়ে যুদ্ধ থামিয়ে থাকেন, তাহলে আগামী দিনে নেতানিয়াহুর জন্য সেটা বড় রাজনৈতিক সংকেত। কারণ, ট্রাম্প একদিকে শান্তি চাইছেন, অন্যদিকে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন—যদি নেতানিয়াহু তার পথে না চলেন, তবে তাকে ছাড়তে তিনি দ্বিধা করবেন না।
অবশেষে বলা যায়, গাজা যুদ্ধবিরতি শুধু এক চুক্তি নয়; এটি মধ্যপ্রাচ্যের নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন। ইসরায়েল এখন এমন এক মোড়ে দাঁড়িয়ে, যেখানে শান্তি ও সংঘাত—দুটোই সমান সম্ভাবনা হয়ে রয়েছে। জনগণ শান্তি চায়, কিন্তু রাজনীতি এখনো আগুনে ঘি ঢালছে। তাই এই যুদ্ধবিরতি শেষ নয়—বরং এক নতুন অনিশ্চয়তার শুরু।
আপনার মতামত জানানঃ