ইসরায়েল ও হামাসের দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে অবশেষে এক নতুন মোড় এসেছে। গাজা উপত্যকা থেকে সেনা প্রত্যাহারের প্রস্তুতি শুরু করেছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বা আইডিএফ। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতি চুক্তির ঘোষণা এসেছে, যা অনেকের কাছে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন এক শান্তির ইঙ্গিত হিসেবে দেখা দিলেও অনেকে এখনো শঙ্কিত—এই যুদ্ধবিরতি আদৌ টিকে থাকবে কি না।
ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী আইডিএফ ইতিমধ্যে গাজা থেকে আংশিক সেনা প্রত্যাহারের প্রস্তুতি শুরু করেছে। এক বিবৃতিতে সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তারা পরিস্থিতি মূল্যায়নের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট মোতায়েন লাইন পর্যন্ত সেনাদের সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। যদিও তারা এখনও পুরোপুরি সরে যায়নি এবং প্রয়োজনে আবারও অভিযানে অংশ নিতে প্রস্তুত রয়েছে। এই পদক্ষেপকে অনেকে ট্রাম্পের ঘোষিত শান্তি চুক্তির বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ হিসেবে দেখছেন।
এর আগে ট্রাম্প ঘোষণা করেন, ইসরায়েল ও হামাস একটি প্রাথমিক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। তিনি বলেন, “খুব শিগগিরই সব জিম্মি মুক্তি পাবে এবং ইসরায়েল তাদের সেনাদের সীমারেখায় ফিরিয়ে নেবে। এটি হবে এক স্থায়ী ও চিরস্থায়ী শান্তির সূচনা।” ট্রাম্প এই চুক্তির মধ্যস্থতায় ভূমিকা রাখা কাতার, মিশর ও তুরস্ককে ধন্যবাদ জানান। তাঁর মতে, এটি শুধু একটি সাময়িক সমঝোতা নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘদিনের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসান ঘটানোর সুযোগ হতে পারে।
হামাসও এক বিবৃতিতে চুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। তারা জানায়, এতে ইসরায়েলের সেনা প্রত্যাহার, বন্দি বিনিময় এবং গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবেশের বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। হামাস দাবি করেছে, ট্রাম্পের প্রস্তাব নিয়ে ‘দায়িত্বশীল ও গম্ভীর’ আলোচনার পর তারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে। চুক্তির সব বিস্তারিত এখনো প্রকাশ করা না হলেও, বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
এক ফিলিস্তিনি সূত্র জানিয়েছে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরায়েলের হাতে আটক প্রায় ২৫০ ফিলিস্তিনি বন্দী এবং গাজার ১ হাজার ৭০০ নাগরিককে মুক্তি দেওয়া হবে। এর বিনিময়ে হামাসও জীবিত ২০ জন ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেবে। নিহত জিম্মিদের মৃতদেহ পরবর্তী ধাপে ফেরত দেওয়া হবে বলে জানা গেছে। হোয়াইট হাউসের এক কর্মকর্তা বলেছেন, প্রথম ধাপের মধ্যে প্রতিদিন গাজায় ৪০০টি ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশ করবে এবং পরে ধাপে ধাপে এই সংখ্যা আরও বাড়ানো হবে। এই উদ্যোগকে আন্তর্জাতিক মহল ইতিবাচক হিসেবে দেখছে, কারণ গাজায় দীর্ঘদিনের অবরোধ ও যুদ্ধের ফলে সেখানে মানবিক বিপর্যয় চরমে পৌঁছেছে।
তবে সব পক্ষই এই সমঝোতাকে একভাবে দেখছে না। ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থী রাজনীতিক ও অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মতরিচ এই চুক্তির বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। তাঁর মতে, জিম্মিদের উদ্ধারের পর ইসরায়েলের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত হামাসকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করা। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, “জিম্মিরা ঘরে ফেরার পরই ইসরায়েলকে সর্বশক্তি দিয়ে হামাসকে নিশ্চিহ্ন করতে হবে, যাতে তারা আর কখনো ইসরায়েলের জন্য হুমকি হয়ে না দাঁড়ায়।”
স্মতরিচ আরও বলেন, তিনি এই যুদ্ধবিরতি চুক্তির পক্ষে ভোট দেবেন না, যদিও এর ফলে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর জোট সরকার ভেঙে যাবে না। তাঁর ভাষায়, “আমরা যেন আবার ৬ অক্টোবরের আগের অবস্থায় না ফিরে যাই, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। কৃত্রিম শান্তি, কূটনৈতিক আলিঙ্গন আর হাসিমুখের আনুষ্ঠানিকতায় বিভ্রান্ত হয়ে যেন ভবিষ্যৎকে বন্ধক না রাখতে হয়।” তাঁর এই মন্তব্য ইঙ্গিত করছে যে ইসরায়েলের অভ্যন্তরেও যুদ্ধবিরতি নিয়ে গভীর মতপার্থক্য রয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইসরায়েলের সেনা প্রত্যাহার ও হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি ইঙ্গিত দেয় এক কৌশলগত পরিবর্তনের। বছরের পর বছর গাজায় সংঘর্ষের পর এখন উভয় পক্ষই ক্লান্ত এবং আন্তর্জাতিক চাপও বৃদ্ধি পেয়েছে। ট্রাম্পের নেতৃত্বে নতুন এই চুক্তি যদি সফল হয়, তাহলে এটি শুধু গাজায় নয়, বরং গোটা মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতার জন্য এক বড় পদক্ষেপ হতে পারে। কিন্তু ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও চরমপন্থী নেতাদের অবস্থান এই শান্তির পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
ফিলিস্তিনি পক্ষ থেকেও কিছু সংশয় দেখা দিয়েছে। হামাস জানিয়েছে, এখনো তারা সেই বন্দিদের চূড়ান্ত তালিকা পায়নি যাদের ইসরায়েল মুক্তি দিতে রাজি হয়েছে। এক ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা বলেন, “আমরা আশা করছি বিষয়টি কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই স্পষ্ট হবে, তবে এখনো আনুষ্ঠানিক নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি।” গাজার স্থানীয়রা বলছেন, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলে বহু পরিবার তাদের হারানো সদস্যদের খবর পাবে, আবার কেউ কেউ ঘরে ফিরতে পারবে—এটাই তাদের এখন একমাত্র আশা।
অন্যদিকে, ইসরায়েলি সেনারা ধীরে ধীরে প্রায় ৭০ শতাংশ এলাকা থেকে সরে আসছে বলে আল–জাজিরা জানিয়েছে। যদিও সামরিক বাহিনী স্পষ্ট জানিয়েছে, তারা পুরোপুরি প্রত্যাহার করছে না, বরং পরিস্থিতি অনুযায়ী অবস্থান পরিবর্তন করছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এটি এক ধরনের “কৌশলগত বিরতি”, যা দিয়ে ইসরায়েল আন্তর্জাতিক চাপ প্রশমিত করছে এবং একই সঙ্গে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত থাকছে।
এই পুরো প্রক্রিয়ায় ট্রাম্পের ভূমিকা বিশেষভাবে আলোচিত। ক্ষমতায় ফিরে মধ্যপ্রাচ্যে নিজের প্রভাব পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে তিনি এই যুদ্ধবিরতি উদ্যোগ নিয়েছেন বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। তাঁর ভাষায়, “এটি শুধু একটি চুক্তি নয়, বরং এক চিরস্থায়ী শান্তির প্রথম পদক্ষেপ।” তবে ইতিহাস বলে, গাজার মতো জটিল এলাকায় এমন শান্তিচুক্তি টেকানো সহজ নয়। অতীতে বহুবার যুদ্ধবিরতির ঘোষণা এসেছে, কিন্তু তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।
এবারের পার্থক্য হলো, যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি কাতার, মিশর ও তুরস্কও সরাসরি মধ্যস্থতায় জড়িত। এই তিন দেশই হামাস ও ইসরায়েল উভয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যোগাযোগ রাখে। ফলে, তাদের সক্রিয় ভূমিকা যুদ্ধবিরতির স্থায়িত্বে প্রভাব ফেলতে পারে। অন্যদিকে, ইরান এখনো এই চুক্তি নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি, যদিও তারা সব সময় হামাসের অন্যতম সমর্থক।
গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলে সবচেয়ে বড় উপকারভোগী হবে সাধারণ মানুষ। মাসের পর মাস ধরে চলা সংঘর্ষে হাজারো মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, বহু এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। খাদ্য, পানি ও চিকিৎসার সংকট তীব্র আকার নিয়েছে। ত্রাণবাহী ট্রাকগুলো যদি নিয়মিতভাবে গাজায় প্রবেশ করতে পারে, তাহলে অন্তত মানবিক বিপর্যয়ের কিছুটা প্রশম হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে যুদ্ধবিরতি টিকে না থাকলে পরিস্থিতি আবারও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
সবশেষে বলা যায়, গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার ও বন্দি বিনিময়ের এই প্রক্রিয়া মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। কিন্তু এই অধ্যায় কতদিন স্থায়ী হবে, তা নির্ভর করছে দুই পক্ষের পারস্পরিক আস্থার ওপর এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ কতটা কার্যকর হয় তার ওপর। শান্তির এই ক্ষীণ আলো জ্বালিয়ে রাখাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ—কারণ, গাজায় শান্তি মানে শুধু দুটি শক্তির যুদ্ধবিরতি নয়, বরং হাজারো সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার পুনরুদ্ধার।
আপনার মতামত জানানঃ