ট্রাম্পের গাজা শান্তি প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যে আলোচনা তৈরি হয়েছে, তা নিছক কূটনৈতিক কোনো উদ্যোগ নয়, বরং অনেকের চোখে এটি ঔপনিবেশিকতার পুনরাবৃত্তি। ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, ১৯১৯ সালে প্রথম মহাযুদ্ধ শেষে পরাজিত তুরস্কের কাছ থেকে ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নিয়ে ব্রিটিশ শাসন চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। স্থানীয় জনগণের মতামত বা আকাঙ্ক্ষার কোনো মূল্য দেওয়া হয়নি। আজ থেকে এক শতাব্দী পর প্রায় একই রকম প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে গাজা নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর সহযোগীরা হোয়াইট হাউসে বসে ২২ লাখ মানুষের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করেছেন, অথচ গাজার মানুষ সেখানে ছিল না।
এই প্রস্তাবে বলা হয়েছে গাজা শাসন করবে একটি আন্তর্জাতিক অন্তর্বর্তী প্রশাসন। নেতৃত্বে থাকবেন যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার, আর বোর্ডের প্রধান হিসেবে থাকবেন ট্রাম্প নিজে। প্রশ্ন জাগে, এটি কি কোনো শান্তি পরিকল্পনা, নাকি গাজার ওপর নতুন করে এক প্রকার ঔপনিবেশিক শাসন চাপিয়ে দেওয়ার কৌশল? পরিকল্পনায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, হামাস কোনো প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকবে না এবং তাদের নিরস্ত্র করে বাইরে ঠেলে দেওয়া হবে। গাজায় যারা শাসনে থাকবেন, তারা হবেন নির্বাচিত ‘টেকনোক্র্যাটিক’ ফিলিস্তিনি। নিরাপত্তার জন্য বাহির থেকে ভাড়া করা হবে সৈন্য ও পুলিশ।
এই পরিকল্পনা পড়লে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের ধাঁচ মনে পড়ে যায়। গাজা যেন কোনো জনগোষ্ঠীর ভূমি নয়, বরং একটি দেউলিয়া করপোরেশন, যার দেখভাল করবে বিদেশি বোর্ড। বিশিষ্ট বিশ্লেষক ড্যানিয়েল লেভি পর্যন্ত বলেছেন, এটি কোনো রাষ্ট্রীয় সমাধান নয়, বরং একটি কমেডির মতো প্রস্তাব—তবে দুঃখের বিষয়, এখানে লাখ লাখ মানুষের ভাগ্য জড়িয়ে আছে।
পরিকল্পনার আরেকটি বড় দিক হলো ফিলিস্তিনের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন। জাতিসংঘের ১৯৪৭ সালের সিদ্ধান্তে দুটি রাষ্ট্রের কথা বলা হয়েছিল—একটি ইসরায়েলি, একটি ফিলিস্তিনি। ইসরায়েল অনেক আগেই রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, কিন্তু ফিলিস্তিন এখনো শুধুই একটি ‘আকাঙ্ক্ষা’। ট্রাম্পের প্রস্তাবে এই স্বাধীনতার বিষয়টি স্বীকার করা হলেও তার বাস্তবায়নের কোনো সুনির্দিষ্ট রূপরেখা দেওয়া হয়নি। বরং বলা হয়েছে, আগে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে সংস্কার করতে হবে এবং ইসরায়েল অনুমতি না দিলে স্বাধীনতার আলো আসবে না। নেতানিয়াহু বহুবার বলেছেন তিনি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র মেনে নেবেন না, এবং এই পরিকল্পনায় তাঁর প্রায় সব দাবি মানা হয়েছে।
আরব বিশ্বে এই প্রস্তাব নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। কেউ কেউ এটিকে সরাসরি ঔপনিবেশিক কৌশল বলে মন্তব্য করেছেন। লেবাননের সাংবাদিক রাশিদা দেরঘাম বলেছেন, এটি কোনো শান্তি পরিকল্পনা নয়, বরং একটি দেউলিয়া প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজমেন্টের মতো আয়োজন। জর্দানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারওয়ান মুয়াশের মতে, এর একমাত্র উদ্দেশ্য হলো ফিলিস্তিনিদের রাজনৈতিক অধিকার অস্বীকার করা। নিউইয়র্ক টাইমস পর্যন্ত লিখেছে, এটি মূলত নেতানিয়াহুর সব দাবি বাস্তবায়নের দলিল।
তবু কেউ কেউ আশার আলো খুঁজছেন এই প্রস্তাবে। কারণ এত দিন ধরে চলতে থাকা গাজায় গণহত্যা থামার কোনো কার্যকর উদ্যোগ আরব বা ইউরোপ কেউ নেয়নি। সেই তুলনায় ট্রাম্পের পরিকল্পনায় অন্তত সহিংসতা কমতে পারে। মিসর, আরব আমিরাতসহ কয়েকটি দেশ এতে সতর্ক সমর্থন জানিয়েছে। পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়াও ইতিবাচক ইঙ্গিত দিয়েছে। তবে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রশ্ন এভাবে ঝুলে থাকলে সেটি কখনোই টেকসই সমাধান হতে পারে না।
অন্যদিকে, ট্রাম্প নিজে দাবি করেছেন তিনি গাজায় শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নোবেল পুরস্কারের যোগ্য। তাঁর প্রচারণার কৌশল হিসেবে এটিকে দেখা হচ্ছে। তিনি অতীতে এমনকি প্রস্তাব দিয়েছিলেন গাজাকে পর্যটনকেন্দ্রে রূপান্তর করবেন এবং গাজাবাসীদের সরিয়ে দেবেন। বর্তমান পরিকল্পনায় সেটি বাদ দেওয়া হয়েছে, বলা হয়েছে মানুষ চাইলে সেখানেই থাকবে। তবে মূল কাঠামো পরিবর্তন হয়নি—বিদেশি বোর্ডের হাতে নিয়ন্ত্রণ, আর ইসরায়েলি শর্তের পূর্ণ বাস্তবায়ন।
গাজার বাস্তবতা হলো, সেখানকার মানুষ অবরুদ্ধ, নিপীড়িত ও নিরাশ্রয়। তাদের ওপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে বাইরের শক্তির দম্ভ থেকে। ঔপনিবেশিক যুগের মতোই এবারও একটি জাতির ভাগ্য নির্ধারণ হচ্ছে তাদের অংশগ্রহণ ছাড়াই। গণহত্যা বন্ধের নামে যদি গাজাবাসীর রাজনৈতিক অধিকার আরও খর্ব করা হয়, তবে এ শান্তি পরিকল্পনা ইতিহাসের কাছে ব্যর্থ দলিল হিসেবেই চিহ্নিত হবে। তবে সত্যি যদি সহিংসতা কমে এবং মানুষ অন্তত কবরের শান্তির বদলে জীবনের শান্তি খুঁজে পায়, তখনই বোঝা যাবে ট্রাম্পের এই প্রস্তাব নিছক রাজনৈতিক প্রদর্শনী, নাকি ইতিহাসের নতুন অধ্যায়।
আপনার মতামত জানানঃ