বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল বহুদিন ধরেই অস্থিরতা ও সংঘাতের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান—এই তিনটি জেলা নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের ভৌগোলিকভাবে সবচেয়ে অনন্য অঞ্চল হলেও এখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা সবসময়ই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি খাগড়াছড়ি সদর ও গুইমারা উপজেলায় ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আবারও প্রমাণ করেছে, পাহাড়ের সমস্যা শুধু উন্নয়ন ঘাটতি বা রাজনৈতিক বিভাজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এখানে সামাজিক অবিশ্বাস, সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও গভীর নিরাপত্তাহীনতা একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। শনিবার এক কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগকে কেন্দ্র করে যে সহিংসতার সূত্রপাত হয়, তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ব্যাপক আকারে। গুইমারায় সংঘর্ষ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় প্রাণহানি ঘটে, আহত হয় সেনা সদস্যরাও। এই পরিস্থিতি পুরো এলাকা জুড়ে এক আতঙ্কজনক আবহ তৈরি করেছে।
অবরোধ, ১৪৪ ধারা, সেনা মোতায়েন—এসব ব্যবস্থার মধ্য দিয়েও এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি জীবনযাত্রা। জেলা সদরের রাস্তাঘাট ফাঁকা পড়ে আছে, অল্প কিছু অটোরিকশা চলতে দেখা গেলেও দোকানপাট বন্ধ, বাজার বসেনি, মানুষের উপস্থিতিও নেই বললেই চলে। সেনা সদস্যদের টহল, পুলিশের কড়া নজরদারি, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি জনজীবনকে আরও চাপা করে তুলেছে। স্থানীয়দের বক্তব্যে উঠে এসেছে আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তার কথা। তারা বলছেন, আহতদের অনেককে হাসপাতালে নেওয়া যাচ্ছে না ভয়ের কারণে, খাবারের সংকটও দেখা দিচ্ছে কারণ বহু দোকানপাট পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে প্রশাসন বলছে, তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য। জেলা প্রশাসক থেকে শুরু করে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা পর্যন্ত দাবি করছেন, নতুন করে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি, সবকিছু ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে। কিন্তু মাঠপর্যায়ের মানুষজন বলছে, আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা এখনো কাটেনি।
এ ঘটনাগুলো কেবল একটি নির্দিষ্ট সময়ের অস্থিরতা নয়, বরং দীর্ঘ দিনের সমস্যার প্রতিফলন। পাহাড়ি ও বাঙালিদের পারস্পরিক অবিশ্বাস এখানে গভীর শিকড় গেড়ে বসেছে। এক পক্ষ অন্য পক্ষকে হামলার জন্য দায়ী করছে। পাহাড়িরা বলছে, তাদের দোকানপাট ও ঘরবাড়িতে আক্রমণ করেছে স্থানীয় বাঙালিরা। অপরদিকে বাঙালি সংগঠনগুলো দাবি করছে, পাহাড়ি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোই সহিংসতায় জড়িত। এই পারস্পরিক দোষারোপের সংস্কৃতি বহু পুরনো, যার সমাধান সহজে আসেনি। সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক বিবৃতিতেও এই দ্বন্দ্বের প্রতিফলন দেখা যায়। তারা দাবি করেছে, ইউপিডিএফসহ বিভিন্ন পাহাড়ি সংগঠন নাশকতার জন্য কোমলমতি শিশু ও নারীদেরও ব্যবহার করছে, বহিরাগত সন্ত্রাসীদের এনে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিবেশ তৈরি করছে। অন্যদিকে জুম্ম ছাত্র জনতা সামাজিক মাধ্যমে পাল্টা বিবৃতি দিয়ে বলছে, সেনাবাহিনী সত্য আড়াল করছে, বাস্তবতাকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করছে। তাদের অভিযোগ, সেনা সদস্যরা সংযমের কথা বললেও বাস্তবে তারা ঘরবাড়ি তল্লাশি, সাধারণ মানুষকে মারধর, নির্বিচারে আটক ও দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ করেছে।
এই পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের ভিড়ে সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, জীবন-জীবিকা হারাচ্ছে, আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। গুইমারার এক মারমা নাগরিক বলেন, “একটা আতঙ্কজনক পরিস্থিতি, কেউ বের হচ্ছে না। আহতরা হাসপাতালে যেতে পারছে না, খাবারের সংকট শুরু হয়েছে।” এমন বক্তব্য পাহাড়ি অঞ্চলের বাস্তবতাকেই তুলে ধরে। অর্থাৎ, প্রশাসন যতোই বলুক পরিস্থিতি শান্ত, মানুষের ভেতরের ভীতি ও অবিশ্বাস কিন্তু এখনো কাটেনি।
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা শুধু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতি বাড়িয়ে সমাধান করা সম্ভব নয়। এখানে সমস্যার মূলে আছে দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বঞ্চনা। শান্তিচুক্তির পর দুই দশকের বেশি সময় পার হয়ে গেছে, কিন্তু সেই চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি। পাহাড়ি জনগোষ্ঠী বারবার অভিযোগ করেছে, তারা যথেষ্ট ক্ষমতা ও অধিকার পাচ্ছে না, ভূমি বিরোধ মীমাংসা হয়নি, উন্নয়নের সুফল সবার কাছে সমানভাবে পৌঁছাচ্ছে না। অপরদিকে বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যেও রয়েছে নিজেদের নিরাপত্তা ও জীবিকা নিয়ে শঙ্কা। ফলে পারস্পরিক অবিশ্বাস আরও গভীর হয়েছে।
খাগড়াছড়ি ও গুইমারার সাম্প্রতিক সহিংসতা একেবারেই হঠাৎ করে তৈরি হয়নি। ধর্ষণের অভিযোগ ছিল শুধু একটি ট্রিগার। এর আড়ালে জমে থাকা ক্ষোভ, অসন্তোষ ও বিভাজন হঠাৎ করেই বিস্ফোরিত হয়েছে। এই পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করতে হলে কেবল সেনা টহল বা প্রশাসনিক কঠোরতা যথেষ্ট নয়। দরকার আস্থা গড়ে তোলা, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, অপরাধীদের বিচার করা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, পাহাড়ি ও বাঙালি উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করা।
আজকের পরিস্থিতি আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছে, শান্তি বজায় রাখার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন অপরিহার্য। পাহাড়ি কিশোরীর ধর্ষণ, সহিংসতা, পাল্টাপাল্টি দোষারোপ—এসব ঘটনায় সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো, সমস্যার মূলে আঘাত না করলে এ ধরনের সংকট বারবার ফিরে আসবে। কেবল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর শক্তি দিয়ে পাহাড়কে শান্ত রাখা সম্ভব নয়। বরং ন্যায়বিচার, আস্থা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ তৈরি করা ছাড়া বিকল্প নেই।
গুইমারা ও খাগড়াছড়ির সাম্প্রতিক পরিস্থিতি আজ আতঙ্কজনক হলেও এর মধ্যেই রয়েছে ভবিষ্যতের জন্য এক সতর্ক সংকেত। এখানে বসবাসকারী মানুষের নিরাপত্তা, শান্তি ও উন্নয়ন নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব পালনে দেরি হলে, এই আতঙ্ক আবারও ছড়িয়ে পড়বে, আস্থার সংকট আরও গভীর হবে, সহিংসতা আবারও রক্তাক্ত করে তুলবে পাহাড়কে। তাই এখন সময় এসেছে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেওয়ার, জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনার এবং দীর্ঘ দিনের সমস্যার মূল সমাধানের পথে এগোনোর। অন্যথায় খাগড়াছড়ি ও গুইমারার মতো আতঙ্কজনক পরিস্থিতি পার্বত্য চট্টগ্রামের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকবে, যা শুধু পাহাড় নয়, গোটা দেশের জন্যই অশনি সংকেত।
আপনার মতামত জানানঃ