মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও মর্যাদা রক্ষা করা একটি সভ্য সমাজের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব। কোনো মানুষই নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে শারীরিক কিংবা মানসিকভাবে নিপীড়িত হতে পারে না। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেসব ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে কিছু ব্যক্তি রাস্তাঘাটে কিংবা জনসমাগমস্থলে দাঁড়িয়ে থাকা ভবঘুরে, ফকির, সাধুবেশী বা মানসিকভাবে অস্থিতিশীল মানুষকে ধরে তাঁদের চুল-দাড়ি জোরপূর্বক কেটে দিচ্ছেন। বিষয়টি নিছক একটি বিনোদনমূলক কনটেন্ট তৈরির উদ্দেশ্যে হলেও, এর মধ্যে লুকিয়ে আছে গভীর মানবাধিকার লঙ্ঘন, সামাজিক বিদ্বেষ এবং ভয়ঙ্কর মানসিক সন্ত্রাসের উপাদান।
ভিডিওতে দেখা যায়, অসহায় মানুষরা সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করেও নিজেদের মুক্ত করতে পারছেন না। তাঁরা চিৎকার করছেন, কাকুতি-মিনতি করছেন, তবু শক্তিশালী কয়েকজন ব্যক্তি তাঁদের চুল ধরে কেটে দিচ্ছেন। এই চিত্র আমাদের সমাজে কী ধরনের মানসিকতা গড়ে উঠছে, তারই প্রতিফলন। ভুক্তভোগীদের মুখে প্রায়ই শোনা যায়, “আল্লাহ তুই দেহিস।” এর অর্থ তাঁরা মানুষের কাছে বিচার না পেয়ে, সৃষ্টিকর্তার কাছেই নিজেদের রক্ষা আশা করছেন। এ যেন রাষ্ট্র ও সমাজের ব্যর্থতার করুণ সাক্ষ্য।
এ ধরনের কনটেন্ট তৈরির মূল উদ্দেশ্য আসলে জনপ্রিয়তা আর অর্থোপার্জন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন ভিডিও ভাইরাল হলে লাখো ভিউ আসে, মন্তব্য হয়, এবং কনটেন্ট নির্মাতারা সেখান থেকে অর্থ উপার্জন করেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষের মৌলিক অধিকারকে পদদলিত করে, একজন অসহায়কে হেয় করে, ভয় দেখিয়ে, তাঁর শরীরের ওপর জোর খাটিয়ে কেমন করে বিনোদন তৈরি হতে পারে? এ ধরনের কাজ শুধু অনৈতিক নয়, সরাসরি অপরাধ।
বিদেশি অনেক কনটেন্ট নির্মাতা দেখা যায় গৃহহীন কিংবা অস্বচ্ছল মানুষদের কাছে গিয়ে তাঁদের চুল-দাড়ি কেটে দিচ্ছেন, নতুন পোশাক দিচ্ছেন, খাবার দিচ্ছেন এবং আর্থিক সহায়তা করছেন। সেসব ভিডিও জনপ্রিয় হয় মূলত সম্মতির কারণে। সেখানে ভুক্তভোগীরা নিজের ইচ্ছায় সাহায্য গ্রহণ করেন, তাঁদের চোখেমুখে আনন্দ ফুটে ওঠে। অথচ আমাদের প্রেক্ষাপটে সম্মতির বিষয়টি একেবারেই অনুপস্থিত। এখানে জোর করে চুল কেটে দেওয়া হয়, অনেক সময় মানুষকে তাড়া করে ধরা হয়, এমনকি ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে তাঁদের ওপর কর্তৃত্ব দেখানো হয়। এই পুরো প্রক্রিয়াই সমাজে মানবিকতা নয়, বরং ভীতিকর শাসন কায়েম করে।
আরও উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে, এই কাজকে ধর্মীয় বা নৈতিকতার ছদ্মবেশে বৈধ করার চেষ্টা চলছে। অনেক সময় কনটেন্ট নির্মাতারা ইসলামি পোশাক-পরিচ্ছদে নিজেদের উপস্থাপন করেন, যেন তাঁরা ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করছেন। অথচ ধর্ম কোনোভাবেই জবরদস্তিকে সমর্থন করে না। পবিত্র কোরআনেই স্পষ্টভাবে বলা আছে, “ধর্মে কোনো জবরদস্তি নেই।” সুতরাং ধর্মের নামে এ ধরনের নিপীড়ন কেবল ভ্রান্ত ধারণা নয়, বরং ধর্মকেও কলঙ্কিত করার সামিল।
সমাজে কিছু মানুষ আবার এসব ভিডিও দেখে প্রশংসা করেন, “ভালো কাজ হচ্ছে।” তাঁরা ভাবেন, ভবঘুরেদের নতুন রূপ দেওয়া মানে সমাজে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। কিন্তু আসলে এ ধারণা বিপজ্জনক। কারণ, এই সমর্থনই কনটেন্ট নির্মাতাদের আরও উৎসাহিত করছে। ফলে অসহায়, প্রান্তিক, মানসিকভাবে অস্থির মানুষরা প্রতিনিয়ত টার্গেটে পরিণত হচ্ছেন। সমাজে তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ বাড়ছে, তাঁরা আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন।
এখানেই বিষয়টি কেবল ব্যক্তির ওপর আঘাত নয়, বরং বৃহত্তর সামাজিক সংকটের জন্ম দিচ্ছে। আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি, শুধু ব্যক্তিকে নয়, মাজার, খানকা কিংবা ধর্মীয় আস্থার কেন্দ্রগুলোতেও হামলা হচ্ছে। ভিন্ন ধর্মীয় বা সামাজিক চর্চাকে দমন করার নামে মাজার ভাঙচুর, আক্রমণ, অগ্নিসংযোগ পর্যন্ত হয়েছে। কেবল ছয় মাসে ৮০টির বেশি মাজার ভাঙচুর হয়েছে বলে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এসব ঘটনা প্রমাণ করে, ব্যক্তি থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠান—সব জায়গায় এক ধরনের সংখ্যাগরিষ্ঠবাদ চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা ভয়ানকভাবে বেড়ে গেছে।
রাষ্ট্র ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। বেশির ভাগ ঘটনায় পুলিশ মামলা নিতে গড়িমসি করছে, অভিযোগকারীর নাম উল্লেখ নেই, আবার কোথাও নামমাত্র গ্রেপ্তার হলেও বিচারপ্রক্রিয়া এগোয় না। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতিই অপরাধীদের উৎসাহ জোগাচ্ছে। তাঁরা জানেন, রাষ্ট্র কোনো পদক্ষেপ নেবে না। ফলে তাঁরা আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠছেন।
একই সঙ্গে এ ঘটনাগুলো রাজনৈতিক ভাবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। কেউ ভালো কাজের নামে ভিডিও বানাচ্ছেন, কেউ আবার জনসমর্থন অর্জনের জন্য নারীর পোশাক বা যৌনকর্মীদের উপস্থিতিকে অজুহাত বানিয়ে হামলা করছেন। আসলে এর ভেতরে লুকিয়ে আছে ক্ষমতার রাজনীতি। সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত চাপিয়ে দেওয়া, ভিন্নকে দমন করা এবং ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করাই তাঁদের উদ্দেশ্য।
কিন্তু একটি সভ্য রাষ্ট্রে এসব আচরণের কোনো স্থান নেই। মানুষের ওপর জোর খাটানো যেমন মানবাধিকারবিরোধী, তেমনি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও অগ্রহণযোগ্য। সমাজের প্রতিটি মানুষের চিন্তা, বিশ্বাস, জীবনযাত্রায় ভিন্নতা থাকবেই। সেই ভিন্নতাকে সম্মান না করে, জোরপূর্বক এক রকম জীবনধারা চাপিয়ে দেওয়ার মানসিকতা দীর্ঘমেয়াদে ভয়াবহ অস্থিরতা তৈরি করবে।
এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রথমত প্রয়োজন আইনের যথাযথ প্রয়োগ। জোর করে চুল কেটে দেওয়া, পোশাক নিয়ে কটূক্তি করা, মাজার ভাঙচুর—এসব সরাসরি অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে। অপরাধীদের শাস্তির আওতায় না আনলে এই প্রবণতা থামানো সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, সামাজিক সচেতনতা তৈরি করতে হবে। মানুষকে বোঝাতে হবে যে কারও ওপর জবরদস্তি করা মানেই তার মর্যাদাকে অস্বীকার করা। ভবঘুরে বা ফকিরদেরও সমান নাগরিক অধিকার আছে, তাঁদেরও স্বাধীনতা আছে।
এ ছাড়া গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলোরও দায়িত্ব আছে। ফেসবুক বা ইউটিউব কর্তৃপক্ষকে এ ধরনের জোরপূর্বক নির্মিত কনটেন্ট সরিয়ে দিতে হবে। অন্যথায় ভিউয়ের লোভে এই ভ্রান্ত সংস্কৃতি চলতেই থাকবে।
সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, আমাদের সমাজে ভিন্নতাকে মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। একজনের জীবনযাপন অন্যের থেকে আলাদা হতে পারে, তাতে সমস্যা নেই। সমস্যা তখনই হয়, যখন আমরা অন্যকে নিজের মতো করে গড়ে তুলতে চাই জোর করে। অথচ প্রকৃত গণতন্ত্র ও মানবিক সমাজ গড়ে ওঠে পারস্পরিক সম্মান আর বৈচিত্র্য গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে।
আজ যদি আমরা নীরব থাকি, ভাবি বিষয়টি কেবল ভবঘুরে কিংবা প্রান্তিক মানুষের, তাহলে ভুল করব। কারণ এই প্রবণতা একসময় সবার জীবনকে স্পর্শ করবে। সংখ্যাগরিষ্ঠবাদ ও জবরদস্তির যে চর্চা এখন চলছে, তা ধীরে ধীরে ছোট ছোট গোষ্ঠী থেকে নির্দিষ্ট ব্যক্তি, পরিবার, এমনকি সাধারণ নাগরিকের জীবনেও নেমে আসবে। তখন আর নিরাপদ থাকবে না কেউই।
তাই আজই আমাদের সোচ্চার হতে হবে। সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। রাষ্ট্রকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। ধর্মকে ব্যবহার করে যারা সহিংসতা করছে, তাঁদের ভ্রান্তি প্রকাশ করতে হবে। প্রতিটি নাগরিককে বুঝতে হবে, অন্যের ওপর জবরদস্তি করার কোনো অধিকার কারও নেই। শুধু রাষ্ট্র বা আইন নয়, নাগরিকেরও দায়িত্ব হচ্ছে ভিন্নতাকে মেনে নেওয়া, মানুষের মর্যাদা নিশ্চিত করা।
সর্বোপরি, একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে হলে মানবিকতার জায়গাটাকেই সবার আগে গুরুত্ব দিতে হবে। জোর করে কারও চুল কেটে দেওয়া, পোশাক নিয়ে ব্যঙ্গ করা বা মাজার ভাঙচুর করার মাধ্যমে সমাজে শান্তি বা ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা হয় না, বরং ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়। আমাদের যদি সত্যিকার অর্থে একটি মর্যাদাপূর্ণ ও নিরাপদ সমাজ চাই, তবে এখনই এসব প্রবণতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। নইলে আমরা সবাই একদিন আক্রান্ত হবো একই চক্রে।
আপনার মতামত জানানঃ