ভারতের কেরালা রাজ্যে এখন এক ভয়ঙ্কর স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখোমুখি হয়েছে সাধারণ মানুষ। বৈজ্ঞানিক ভাষায় নেগলেরিয়া ফাওলেরি নামে পরিচিত এই প্রাণঘাতী জীবাণু বা “মস্তিষ্ক-খেকো অ্যামিবা” আতঙ্ক ছড়িয়েছে পুরো রাজ্যে। গত নয় মাসে অন্তত ৬৭ জন আক্রান্ত হয়েছেন এই বিরল রোগে, যার মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১৮ জনের। শুধু সেপ্টেম্বর মাসেই প্রাণ হারিয়েছেন সাতজন। আক্রান্তদের মধ্যে রয়েছে শিশু, কিশোরী এবং মধ্যবয়সী নারীও। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা সতর্কবার্তা জারি করেছেন, কারণ এখনো পর্যন্ত এই রোগের কার্যকর চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয়নি।
মস্তিষ্ক-খেকো অ্যামিবা আসলে একধরনের এককোষী জীব, যা উষ্ণ পানিতে জন্মায়। সাধারণত পুকুর, নদী, লেক বা সুইমিং পুলের পানিতেই এরা বেশি পাওয়া যায়। কোঝিকোড় মেডিকেল কলেজের স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রবি শঙ্করের মতে, অ্যামিবা নিজে থেকে মানুষকে আক্রমণ করে না। কিন্তু কেউ যদি ওই পানিতে সাঁতার কাটে এবং নাকের ভেতর পানি ঢুকে যায়, তখন অ্যামিবা নাকের ভেতরের টিস্যুর মাধ্যমে মস্তিষ্কে পৌঁছে যায়। সেখানে গিয়ে এটি মস্তিষ্কের টিস্যু খেতে শুরু করে এবং তৈরি করে মারাত্মক প্রদাহ, যা মেনিনজাইটিস-এর মতো প্রাণঘাতী রোগে রূপ নেয়। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে, আক্রান্তদের মধ্যে ৯৫ শতাংশই মৃত্যুবরণ করেন। ফলে চিকিৎসকরা এটিকে ‘প্রায় নিশ্চিত মৃত্যু-ডাক’ হিসেবেই বিবেচনা করছেন।
কেরালার কোঝিকোড়, কান্নুপুর এবং মালাপ্পুরম জেলায় রোগটির প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। আগস্ট মাসে কোঝিকোড়ে তিনজনের মৃত্যু হয়েছিল—তাদের মধ্যে ছিলেন মাত্র তিন মাসের এক শিশু, নয় বছরের এক কিশোরী এবং ৫২ বছর বয়সী এক নারী। সেপ্টেম্বরেও রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে সাতজনের মৃত্যু হয়। সর্বশেষ ঘটনা ঘটেছে তিরুঅনন্তপুরমে। এক কিশোর স্থানীয় আক্কুলাম গ্রামে বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে সুইমিং পুলে নামার কয়েকদিন পর অসুস্থ হয়ে পড়ে। মাথাব্যথা, জ্বর ও স্নায়ুবিক জটিলতা দেখা দিলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, কিন্তু চিকিৎসকদের চেষ্টায়ও তাকে বাঁচানো যায়নি। এই ঘটনার পরই স্থানীয় প্রশাসন সুইমিং পুলটি বন্ধ করে দিয়েছে এবং পরীক্ষার জন্য পানির নমুনা সংগ্রহ করেছে।
অ্যামিবার অস্তিত্ব মূলত উষ্ণ পানিতে। কেরালার জলবায়ু উষ্ণ ও আর্দ্র হওয়ায় এ ধরনের জীবাণুর বিস্তার দ্রুত ঘটে। বিশেষজ্ঞদের মতে, জলাশয়ে সাঁতার বা স্নান করার সময় নাক দিয়ে পানি প্রবেশ করলে অ্যামিবার মস্তিষ্কে পৌঁছানো সবচেয়ে বড় ঝুঁকি। তবে একটি স্বস্তির বিষয় হলো, এই রোগ মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না। অর্থাৎ এটি সংক্রামক নয়। কিন্তু সংক্রমণের পর দ্রুত রোগের অগ্রগতি এবং কার্যকর চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুর হার অত্যন্ত বেশি।
সাধারণত সংক্রমণের ২–১০ দিনের মধ্যে উপসর্গ দেখা দেয়। এর মধ্যে প্রধান হলো প্রচণ্ড মাথাব্যথা, উচ্চ জ্বর, ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া, বমি, বিভ্রান্তি বা খিঁচুনি এবং পরে দেখা দেয় স্নায়ুবিক সমস্যা। ডাক্তাররা পরামর্শ দিয়েছেন, সাঁতার কাটার পর যদি মাথাব্যথা বা জ্বর হয়, তাহলে অবিলম্বে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। কারণ প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্ত করা গেলে কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করে সামান্য হলেও রোগীর জীবন রক্ষা সম্ভব হতে পারে। প্রতিরোধের জন্য অপরিষ্কার বা উন্মুক্ত জলাশয়ে সাঁতার না কাটা, সুইমিং পুলে নামলে নাক বন্ধ রাখতে বিশেষ ক্লিপ ব্যবহার করা, নাকের ভেতরে পানি প্রবেশ না করতে সচেতন থাকা এবং আক্রান্ত এলাকার পানিকে নিয়মিত পরীক্ষার আওতায় আনার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
নেগলেরিয়া ফাওলেরি হল এক ধরনের ফ্রি-লিভিং অ্যামিবা। এর জীবনচক্র তিনটি ধাপে বিভক্ত— সিস্ট, ট্রফোজোইট এবং ফ্লাজেলেট। মানুষের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হলো ট্রফোজোইট ধাপ, যেখানে এটি সক্রিয় হয়ে মস্তিষ্কের কোষ আক্রমণ করে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে রোগটিকে বলা হয় Primary Amoebic Meningoencephalitis (PAM)। এটি এক ধরনের মারাত্মক স্নায়ুরোগ, যা মস্তিষ্কে প্রদাহ ও টিস্যু ধ্বংসের মাধ্যমে মৃত্যু ডেকে আনে।
বর্তমানে এই রোগের কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। কিছু অ্যান্টিফাঙ্গাল ও অ্যান্টিপ্রোটোজোয়াল ওষুধ প্রয়োগ করা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগীকে বাঁচানো যায় না। মূল সমস্যা হলো রোগের গতি এত দ্রুত যে সঠিক চিকিৎসার সময়ই পাওয়া যায় না। এই কারণেই প্রতিরোধকে সবচেয়ে কার্যকর সমাধান হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পানির গুণমান পরীক্ষা, সুইমিং পুলে পর্যাপ্ত ক্লোরিন ব্যবহার এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো ছাড়া এই ভয়ঙ্কর রোগ মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।
কেরালার এই ভয়াবহ পরিস্থিতি গোটা দেশকেই সতর্ক করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পানির তাপমাত্রা ও গুণগত মান দ্রুত বদলে যাচ্ছে, ফলে এ ধরনের রোগ আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই সময় এসেছে মানুষকে আরও সতর্ক হওয়ার, সঠিক নিয়ম মেনে পানির ব্যবহার করার এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত করার। কারণ মস্তিষ্ক-খেকো অ্যামিবা শুধু কেরালার সমস্যা নয়, বরং এটি ভবিষ্যতে বৈশ্বিক স্বাস্থ্যঝুঁকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ