ইসলামী ছাত্রশিবির বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির ইতিহাসে একটি বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত সংগঠন। এর জন্ম হয় ১৯৭৭ সালে জামায়াতে ইসলামী–সংলগ্ন ছাত্র সংগঠন হিসেবে। জন্মলগ্ন থেকেই শিবির নিজেদের লক্ষ্য স্থির করে ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা এবং তরুণ প্রজন্মকে সেই আদর্শে গড়ে তোলা। সংগঠনটির আদর্শিক মূলনীতি ছিল শরীয়াভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চিন্তা, আর সেই লক্ষ্যেই তারা ধীরে ধীরে নিজেদের বিস্তার ঘটায় বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদরাসায়। শুরুতে এটি ধর্মীয় চেতনা জাগ্রত করার সংগঠন হিসেবে পরিচিত হলেও দ্রুতই রাজনৈতিক চরিত্র ধারণ করে নেয়।
আশির দশকে সামরিক শাসনের সময় শিবির ছাত্রশক্তি হিসেবে পরিচিতি পেতে শুরু করে। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, কক্সবাজারসহ বড় বড় শিক্ষাঙ্গনে তারা নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালায়। তবে এই বিস্তার কখনোই ছিল না শান্তিপূর্ণ। ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নসহ অন্য সংগঠনের সঙ্গে শিবির বারবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হল দখল, প্রতিপক্ষকে নির্যাতন, অস্ত্রধারী রাজনীতি—এসবের মধ্য দিয়ে শিবির এক ভয়াবহ সহিংস অধ্যায়ের সূচনা করে। অনেক ক্ষেত্রেই ভিন্নমতের ছাত্ররা তাদের নির্যাতনের শিকার হয়। ধর্মীয় আচরণ না মানলে কিংবা সংস্কৃতি চর্চায় অংশ নিলে শিক্ষার্থীদের ওপর শারীরিক ও মানসিক চাপ সৃষ্টি করা হতো।
রাষ্ট্রীয়ভাবে শিবিরের ওপর সবসময় নজরদারি ও দমননীতি চালু ছিল। জামায়াতে ইসলামী মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানপন্থী অবস্থান নেওয়ায়, শিবিরকেও সেই দায় বহন করতে হয়েছে। বহুবার সরকার তাদের “উগ্রবাদী” বা “জঙ্গিবাদী” হিসেবে চিহ্নিত করেছে। শিবির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নানা মামলা, গ্রেফতার ও কারাবাস ঘটেছে। এমনকি ক্রসফায়ারের ঘটনাও তাদের ইতিহাসের অংশ। তবে শিবির সবসময় নিজেদের নির্দোষ দাবি করেছে এবং বলেছে তারা কেবল ইসলামি আদর্শ প্রচার করে। কিন্তু সমাজে ও রাষ্ট্রে তাদের প্রতি অবিশ্বাস থেকে গেছে, কারণ ক্যাম্পাসে তাদের কার্যকলাপ বহুবার সহিংসতা উস্কে দিয়েছে।
ধর্মীয় উগ্রতার অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি। শিবির মনে করে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা মুসলিম সমাজের জন্য উপযুক্ত নয়। তাদের আদর্শ অনুযায়ী খিলাফত বা শরীয়াভিত্তিক রাষ্ট্রই চূড়ান্ত সমাধান। ফলে বাংলাদেশের সংবিধান, বিশেষ করে ধর্মনিরপেক্ষ ধারাগুলো তারা সমালোচনা করেছে। তারা সংস্কৃতি চর্চার বিরোধিতা করেছে এবং এটিকে ইসলামবিরোধী বলে প্রচার করেছে। বৈশাখী উৎসব, নাটক, গান—এসবকে দমন করার চেষ্টা তাদের ইতিহাসে অনেকবার দেখা গেছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়েও তারা ভিন্ন ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছে, যা মূলধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
শিবির থেকে বেরিয়ে যাওয়া বা প্রভাবিত হওয়া কিছু তরুণ পরবর্তীতে জঙ্গি সংগঠনে যোগ দিয়েছে—এমন অভিযোগও একাধিকবার উঠেছে। যদিও সংগঠনটি সবসময় এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে, তবুও রাষ্ট্র ও সাধারণ মানুষের মনে তাদের প্রতি সন্দেহ গভীর। এই সন্দেহের কারণে শিবির কখনোই পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য হতে পারেনি।
এবার যদি ঢাকার মতো দেশের কেন্দ্রীয় শিক্ষাঙ্গন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু নির্বাচনে শিবির জয়ী হয়, তবে তার প্রভাব হবে ভয়াবহ। প্রথমত, জামায়াতে ইসলামী পুনর্গঠিত হওয়ার বড় সুযোগ পাবে। যুদ্ধাপরাধের বিচার ও রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে জামায়াতের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়েছে। শিবির ডাকসুতে জিতলে তা জামায়াতকে পুনরায় জাতীয় রাজনীতিতে শক্তি সঞ্চয় করতে সাহায্য করবে।
দ্বিতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে ধর্মীয় চাপ বাড়বে। শিক্ষার্থীদের পোশাক, সংস্কৃতি চর্চা, উৎসব উদযাপন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হবে। বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীরা আরও বেশি চাপের মুখে পড়বে। তাদের ওপর ধর্মীয় বিধিনিষেধ আরোপ বাড়বে। এতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ সঙ্কুচিত হবে, স্বাধীন মতপ্রকাশ সীমিত হয়ে পড়বে।
তৃতীয়ত, সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে এবং হয়তো সক্রিয়ভাবে ক্যাম্পাসের কার্যক্রমে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকবে। ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের ছাত্র সংগঠন যেমন ছাত্রলীগ, প্রগতিশীল ছাত্রজোট বা বাম সংগঠনগুলো আরও দুর্বল হয়ে পড়বে। সহিংসতা ও সংঘর্ষ আবারও বিশ্ববিদ্যালয়ের রোজকার বাস্তবতা হয়ে উঠতে পারে।
জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটেও শিবিরের জয় বড় প্রভাব ফেলবে। ডাকসু নির্বাচন সবসময় জাতীয় রাজনীতির প্রতিফলন ঘটিয়েছে। এখান থেকে জাতীয় নেতারা উঠে এসেছেন। শিবিরের জয় মানে জাতীয় পর্যায়ে তাদের নেতৃত্ব তৈরির সুযোগ পাওয়া। ফলে দেশের রাজনীতিতে ধর্মীয় মেরুকরণ আরও বাড়বে। একদিকে ধর্মভিত্তিক শক্তি, অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শক্তি—এভাবে সমাজ বিভক্ত হয়ে পড়বে।
এই বিভাজনের ফলে গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়বে। নারীবাদী আন্দোলন, প্রগতিশীল চেতনা, সংখ্যালঘু অধিকার—এসব আরও বেশি সংকটে পড়বে। দেশ ধীরে ধীরে পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের মতো রাষ্ট্রব্যবস্থার দিকে গড়িয়ে যেতে পারে, যেখানে ধর্মীয় উগ্রবাদ সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি স্তরে প্রভাব বিস্তার করে।
তবে শিবিরের জয়কে কেবল তাদের সাংগঠনিক শক্তি হিসেবে দেখা যাবে না। এটি দেশের রাজনৈতিক ব্যর্থতারও প্রতিফলন হবে। দুর্নীতি, বেকারত্ব, দমননীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা—এসব কারণে তরুণ সমাজ বিকল্প খুঁজতে বাধ্য হয়। যখন তারা মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আস্থা হারায়, তখন ধর্মভিত্তিক সংগঠন তাদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়। শিবিরের জয় তাই কেবল একটি সংগঠনের উত্থান নয়, বরং জাতীয় রাজনৈতিক সংকটের বহিঃপ্রকাশ।
সব মিলিয়ে বলা যায়, ইসলামী ছাত্রশিবিরের ইতিহাস ধর্মীয় উগ্রবাদ, সহিংসতা, নির্যাতন ও দমননীতির গল্পে পূর্ণ। তারা যেমন রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হয়েছে, তেমনি নিজেরাও সহিংস রাজনীতির দায় এড়াতে পারে না। ডাকসু নির্বাচনে তাদের জয় হলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক কাঠামো, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি ও সামাজিক সম্প্রীতির জন্য এক বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। দীর্ঘমেয়াদে এটি দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলবে, যেখানে ভিন্নমত, সংখ্যালঘু, নারী ও প্রগতিশীল আন্দোলনের কোনো নিরাপদ জায়গা অবশিষ্ট থাকবে না।
আপনার মতামত জানানঃ