মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সম্পর্ক বরাবরই এক অদ্ভুত ভারসাম্যের উপর দাঁড়িয়ে আছে। দুই দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, বৃহৎ বাজার, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং কৌশলগত স্বার্থের মিল থাকা সত্ত্বেও তাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের ভেতরে সবসময় এক ধরনের অবিশ্বাস, প্রতিযোগিতা এবং দ্বিধা কাজ করে। নরেন্দ্র মোদি যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে উঠলেন, তখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সির সময়কার দৃশ্যপট ভারতীয়দের কাছে এক নতুন আশার জন্ম দিয়েছিল। জনসমক্ষে উভয়ের হাসি, হাত মেলানো, বড় বড় জনসভা—সব মিলিয়ে মনে হয়েছিল ভারত-মার্কিন সম্পর্ক ইতিহাসের সেরা সময়ে পৌঁছেছে। ‘হাউডি মোদি’ এবং ‘নমস্তে ট্রাম্প’-এর মতো ইভেন্টগুলো ছিল সেই নাটকীয়তার প্রতীক। কিন্তু সেই উষ্ণতা আসলে কতটা বাস্তব ছিল, আর কতটা কেবলই রাজনৈতিক প্রদর্শনী—এ প্রশ্নের উত্তর সময়ই দিয়েছে।
ট্রাম্পের রাজনৈতিক দর্শন আসলে কোনো সুসংবদ্ধ মতাদর্শ নয়। তিনি নিজের প্রতিটি সিদ্ধান্তকে ব্যক্তিগত বিজয়-পরাজয়ের খেলায় পরিণত করেন। ক্ষমতার প্রদর্শন, প্রতিপক্ষকে চাপে রাখা, এবং নিজের শর্তে চুক্তি করানো—এই তিনটি বিষয় তাঁর রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি। এর মধ্যে কূটনীতির প্রচলিত নীতি, দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কের যত্ন নেওয়া বা ‘উভয় পক্ষের লাভ’—এসব ধারণা তাঁর রাজনৈতিক অভিধানে তেমন জায়গা পায় না। তাই ভারত যখন তাঁর কাঙ্ক্ষিত একতরফা বাণিজ্যচুক্তিতে রাজি হয়নি, তখন প্রতিক্রিয়াও এসেছিল সেই স্বভাবসুলভ রাগ ও প্রতিশোধের ভঙ্গিতে—৫০ শতাংশ শুল্ক বসিয়ে দেওয়া হয় ভারতের ওপর, যা এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ এবং সম্ভবত বিশ্বের মধ্যেও অন্যতম।
২০২০ সালের আহমেদাবাদের ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ১ লাখ ২৫ হাজার মানুষের সামনে ট্রাম্পকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন মোদি। এই দৃশ্য ভারতীয় গণমাধ্যমে এবং রাজনীতিতে এক ধরনের বিজয়ের বার্তা হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছিল। জনসমাগম, করতালির শব্দ, এবং রাজনৈতিক প্রতীকবাদের মাধ্যমে বোঝানো হয়েছিল যে দুই দেশের নেতাদের মধ্যে এক অনন্য বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। কিন্তু বাস্তবে ট্রাম্পের দৃষ্টিতে এই অভ্যর্থনা ছিল কেবলই একবারের বিনোদন, যার সঙ্গে কোনো দীর্ঘমেয়াদি নীতিগত প্রতিশ্রুতি জড়িত ছিল না। বরং নেপথ্যে, নিজের সহকর্মীদের সঙ্গে মোদির উচ্চারণ নিয়ে ব্যঙ্গ করাও তাঁর কাছে ছিল স্বাভাবিক।
ট্রাম্পের প্রতি ভারতের ডানপন্থী অংশের একটি বিশেষ আকর্ষণের পেছনে ছিল তাঁর মুসলিমবিরোধী নীতি। যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম-অধ্যুষিত দেশের নাগরিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপের মতো পদক্ষেপ, কিংবা অভ্যন্তরীণভাবে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আইন কার্যকর করার প্রবণতা—এসব ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হয়েছিল। এমনকি তাঁর প্রথম নির্বাচনী প্রচারণার সময় দিল্লিতে হিন্দুত্ববাদীরা তাঁর অনুপস্থিতিতেই জন্মদিন পালন করেছিল। এই প্রতীকী মিলন আসলে উভয় দেশের ডানপন্থী রাজনীতির একটি অস্থায়ী সংযোগ, যা অর্থনৈতিক বাস্তবতায় এসে টিকতে পারেনি।
ট্রাম্প-পুতিন সম্পর্কের রহস্য আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এক দীর্ঘ আলোচনার বিষয়। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রতি ট্রাম্পের এক অস্বাভাবিক নম্রতা ও অনুরাগ রয়েছে, যা ব্যাখ্যা করার জন্য অনেকে ব্ল্যাকমেইলের তত্ত্বও উত্থাপন করেছেন। কিন্তু ভারতের প্রতি ট্রাম্পের কঠোর মনোভাব ও রাশিয়ার প্রতি তাঁর নরম অবস্থান মিলিয়ে দেখা গেলে বিষয়টি আরও জটিল হয়। ট্রাম্প দাবি করেছেন যে ভারতের রাশিয়া থেকে তেল কেনা তাঁর ক্ষোভের কারণ, যদিও বাস্তবে তিনি তেলের বাজার বা ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে তেমন মাথা ঘামান না। বরং তাঁর আসল ক্ষোভ ভারতের নিজের অবস্থানে অটল থাকা—তিনি চেয়েছিলেন ভারতও যেন অন্য দেশের মতো তাঁর অন্যায্য বাণিজ্যশর্ত মেনে নেয়।
এখানে ভারতের ইতিহাস ও কূটনৈতিক আচরণ গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতার পর থেকে ভারত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সবসময়ই নিজের অধিকারের ব্যাপারে সংবেদনশীল থেকেছে। ওয়াশিংটন হোক বা অন্য কোনো রাজধানী—ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীদের প্রায়শই ‘অত্যধিক খুঁতখুঁতে’ এবং ‘জাতীয় সম্মান নিয়ে অতিসংবেদনশীল’ হিসেবে দেখা হয়। বাণিজ্যচুক্তি বা কূটনৈতিক সমঝোতায় এমন কোনো ছাড়, যা অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে জাতীয় অপমান হিসেবে দেখা যেতে পারে, ভারত বরাবরই এড়িয়ে গেছে। বিজেপি, কংগ্রেস বা অন্য কোনো দল ক্ষমতায় থাকুক না কেন, এই মনোভাবের ধারাবাহিকতা লক্ষণীয়, যা জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হিসেবেই ব্যাখ্যা করা যায়।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে অনেক দেশই—যেমন পাকিস্তান, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো বৃহৎ বাণিজ্যগোষ্ঠী—ট্রাম্পের একতরফা শর্ত মেনে নিয়েছে। তারা এক ধরনের অনানুষ্ঠানিক ‘চুক্তি’ করেছে, যাতে যুক্তরাষ্ট্রে তাদের রপ্তানি গেলে তা উচ্চ শুল্কের মুখে পড়বে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তাদের দেশে শুল্কমুক্ত রপ্তানি করতে পারবে। এই সমঝোতা আইনি বাধ্যবাধকতাহীন এবং ট্রাম্প প্রায়শই নিজের সিদ্ধান্ত বদলান বলে অনেকে মনে করে ভবিষ্যতে হয়তো এসব শর্ত কার্যকর হবে না। কিন্তু ভারত কয়েক শতাংশ শুল্ক ছাড়ের জন্য এই ‘জাতীয় মর্যাদা বিসর্জন’ দিতে রাজি হয়নি।
এই অবস্থান শুধু নীতিগত দৃঢ়তার প্রতীক নয়, বরং বৈশ্বিক বাণিজ্যযুদ্ধে ভারতের কৌশলগত প্রস্তুতিরও ইঙ্গিত। চীন, ব্রাজিল ও কানাডার মতো দেশও ট্রাম্পের দাবির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। যারা নতি স্বীকার করেছে, তাদের নাগরিকদের ক্ষোভের মুখে পড়তে হতে পারে, যখন একতরফা শুল্ক কার্যকর হবে এবং দেশীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ভারত জানে, একবার যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এমন শর্তে মাথা নোয়ালে ভবিষ্যতে অন্যায্য দাবির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করা আরও কঠিন হয়ে যাবে।
এখানে একটি গভীর শিক্ষা রয়েছে—ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতির অস্থিরতা ও স্বেচ্ছাচারিতা কোনো দেশের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। ট্রাম্পের মতো নেতা, যার কাছে সম্পর্ক মানে একজন বিজয়ী ও একজন পরাজিত, কোনো স্থায়ী মিত্র বা পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম নন। তাঁর কাছে ‘উভয় পক্ষের জয়’ ধারণাটি বোধগম্য নয়। তাই ভারতের মতো রাষ্ট্রের জন্য কূটনীতির মূলভিত্তি হওয়া উচিত নীতি-নির্ভর এবং প্রতিষ্ঠানভিত্তিক সম্পর্ক, যা ব্যক্তিগত খেয়ালের ওঠানামার উপর নির্ভরশীল নয়।
দীর্ঘমেয়াদে ভারত-মার্কিন সম্পর্ক কেমন হবে, তা অনেকাংশেই নির্ভর করবে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও নেতৃত্বের পরিবর্তনের উপর। কিন্তু বর্তমান অভিজ্ঞতা ভারতের জন্য একটি সতর্কবার্তা—অতীতের উষ্ণ ছবি ও জনসমাবেশের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো নীতিগত ধারাবাহিকতা, পারস্পরিক সম্মান, এবং বাণিজ্য ও কূটনীতির ক্ষেত্রে সমতার ভিত্তি নিশ্চিত করা। ট্রাম্প হয়তো একদিন ক্ষমতার বাইরে চলে যাবেন, কিন্তু ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতির ঝুঁকি থেকে শিক্ষা নেওয়াই হবে ভারতের ভবিষ্যৎ সাফল্যের চাবিকাঠি।
আপনার মতামত জানানঃ