বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক ‘পোশাক নির্দেশনা’ জারি ও পরবর্তীতে তা প্রত্যাহার—এই ঘটনাটি যেন কেবল একটি সরকারি অফিসের প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং রাষ্ট্রীয় মানসিকতা ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা বিষয়ে এক গভীর সংকেত বহন করে। যখন একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যা মূলত আর্থিক স্থিতিশীলতা ও নীতিনির্ধারণের দায়িত্বে নিয়োজিত, আচমকাই কর্মীদের পোশাকের ধরন নিয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করতে চায়, তখন প্রশ্ন ওঠে—ব্যাংক কি তার কার্যপরিধির বাইরে গিয়ে এক ধরনের ‘নৈতিক পুলিশিং’-এ মেতে উঠছে?
এই ঘটনা মনে করিয়ে দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পরিচিত ঘটনাকে—যেখানে এক কর্মচারী নারী শিক্ষার্থীর ওড়না ঠিক করার নির্দেশ দিয়ে তাকে রাস্তায় হেনস্তা করেছিলেন। তখন যেমন সমাজের এক অংশ ওই কর্মচারীকে নৈতিকতার রক্ষাকর্তা হিসেবে দেখে তাকে রেহাই দিয়েছিল, তেমনি বাংলাদেশ ব্যাংকের এই ‘নৈতিক পোশাকবিধি’ও যেন কোনো অদৃশ্য ‘তৌহিদি জনতা’-র চাপে তৈরি হয়। যদিও দ্রুত প্রতিক্রিয়ার কারণে এবং গভর্নরের হস্তক্ষেপে তা প্রত্যাহার করা হয়, তবুও কর্মীদের বিশেষত নারী কর্মীদের মনে এর রেশ থেকে যাবে—এ কথা অনস্বীকার্য।
এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে যে রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে, তা ভয়ানক। যখন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যক্তির পোশাক, ভাষা, রুচি বা জীবনযাপনের ধরনে হস্তক্ষেপ করতে চায়, তখন তা শুধু সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘনের শামিল নয়, বরং এক প্রকার সামাজিক ইঞ্জিনিয়ারিং। সংবিধান নাগরিকের ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকার সুরক্ষিত রাখার অঙ্গীকার করেছে। সংবিধানের ৩২ ও ৩৯ অনুচ্ছেদ পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয়, কী পরবে বা কীভাবে চলবে—এটা ব্যক্তির নিজস্ব বিষয়।
কিন্তু যখন কোনো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বলে দেয় কে কী ধরনের পোশাক পরবে, তখন প্রশ্ন জাগে—এই শালীনতার সংজ্ঞা কে ঠিক করছে? সেটা কি কারও ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে এসেছে? নাকি কেউ চায় সরকারি প্রতিষ্ঠানে ‘নতুন আদর্শ’ প্রতিষ্ঠা করতে? যেকোনোভাবেই হোক, এটা একটি আধুনিক, বহুমাত্রিক সমাজের জন্য বিপজ্জনক বার্তা।
আরও গভীরে তাকালে দেখা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নির্দেশনার পেছনে রয়েছে এক ধরনের বর্ণগত, সাংস্কৃতিক ও শ্রেণি-ভিত্তিক মানসিকতা। নির্দেশনায় বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাশ করে আসা তরুণ কর্মীদের ‘বিশ্ববিদ্যালয়ধর্মী’ আচরণ নিয়ন্ত্রণে আনতেই নাকি এই পোশাকবিধি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ধর্মী আচরণ বলতে আসলে কী বোঝায়? তরুণেরা পেশাগত পরিবেশে মানিয়ে নিতে কিছুটা সময় নেবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক। সে জন্য তো তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, নির্দেশনা নয়। তাহলে এই ‘বিশ্ববিদ্যালয়ধর্মী আচরণ’ থেকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ভীত কেন?
তাছাড়া বাংলাদেশ যে একটি সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে ভরপুর দেশ, সেখানে পোশাক নিজেই বহুরকম সাংস্কৃতিক চর্চা ও রুচির বহিঃপ্রকাশ। শহরের পোশাক যেমন, গ্রাম বা উপজেলায় তার রূপ ভিন্ন। ঢাকার অফিসগুলোতে যেভাবে ড্রেসকোড অঘোষিতভাবে পালিত হয়, সেটাই যদি রাজশাহী বা কুমিল্লার অফিসে চাপিয়ে দেওয়া হয়, সেটা অযৌক্তিক নয় কি?
এ প্রসঙ্গে ইতিহাসও আমাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেয়। যেমন, খোদ মহাত্মা গান্ধী তার পশ্চিমা পোশাক ত্যাগ করেছিলেন কৃষকের মতো থাকার জন্য। কারণ তিনি বুঝেছিলেন, নেতৃত্ব মানে কেবল আদেশ দেওয়া নয়, বরং নিজেকে সংখ্যালঘু, নিপীড়িতের সঙ্গে সংযুক্ত করা। বা যেমন, শাড়ির বর্তমান রূপ—ব্লাউজ ও পেটিকোটের প্রচলন যে ঠাকুরবাড়ির নারীদের হাত ধরে এসেছে, তা এক সময় ‘অশোভন’ বলে কটাক্ষের শিকার হয়েছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা হয়ে উঠেছে মধ্যবিত্তের আদর্শ পোশাক। ফলে পোশাক নিয়ে সামাজিক চাপ বা নিয়ন্ত্রণ মানে শুধু দমন নয়, বরং ইতিহাসের একচোখা পাঠও।
সামাজিক মাধ্যমে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যেই কি এমন অশালীন কিছু ঘটেছে, যার জন্য এই নির্দেশনা প্রয়োজন হয়েছিল? কিন্তু নিজেই মানবসম্পদ বিভাগের পরিচালক বলেছেন—না, এমন কিছু ঘটেনি। তাহলে কেন এই ‘প্রয়োগ’? কেউ কি ‘উপর মহলে’ নিজের আনুগত্যের প্রমাণ দিতে চেয়েছেন? কেউ কি ভাবছেন, ‘নীতিনৈতিকতা’ প্রতিষ্ঠার নামে ভবিষ্যতে উচ্চপদে পদোন্নতির পথ খুলে যাবে?
এখানেই সবচেয়ে বড় উদ্বেগের জায়গা। রাষ্ট্র যদি সত্যিই মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকারকে সম্মান করে, তাহলে কোনো ‘নিয়ন্ত্রণবাদী প্রবণতা’ই গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি ‘ব্যাংকারদের পেশাদারিত্ব’ নিশ্চিত করতে চায়, তাহলে প্রশিক্ষণ, পরিবেশ এবং কাজের স্বচ্ছতা নিয়ে কাজ করতে পারে। পোশাক ধরে ধরে নির্দিষ্ট করে দেওয়াটা বরং প্রতীকের মতো—যে রাষ্ট্র ব্যক্তি নয়, ব্যবস্থাই নিয়ন্ত্রণ করতে চায়।
সবচেয়ে বড় কথা, এই ধরণের অনুপ্রবেশে কেউ একজন রুখে দাঁড়াতে না পারলে তা ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠান থেকে সমাজ, সমাজ থেকে রাষ্ট্রযন্ত্রে ছড়িয়ে পড়ে। তখন চুপচাপ নির্দেশ মানা কর্মী, কিংবা রাস্তায় ‘শালীনতা’ রক্ষা করতে গিয়ে হেনস্তাকারী অর্ণবের মতো মানুষই হয়ে ওঠে আদর্শ নাগরিক। তখন আর কেউ জিজ্ঞাসা করে না—কে নির্ধারণ করল শালীনতার সংজ্ঞা?
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা যেমন এক দিনে প্রত্যাহার হয়েছে, তেমনি রাষ্ট্রীয় মানসিকতার এই ‘নিয়ন্ত্রণ-আকাঙ্ক্ষা’ও যদি এক দিনে চুপসে যেত! কিন্তু আমরা জানি, বিষয়টি একদিনে থামবে না। এই প্রবণতা ক্রমশ বাড়বে—যতক্ষণ না আমরা নিজেদের প্রশ্ন করি: রাষ্ট্রের কাজ কি নিয়ন্ত্রণ, নাকি স্বাধীনতা রক্ষা? সেই উত্তর খুঁজতেই হয়তো আমাদের আরও অনেক ‘অর্ণব’, আরও অনেক ‘নির্দেশনা’, আরও অনেক ‘প্রতিরোধ’ দেখতে হবে।
আপনার মতামত জানানঃ