বর্তমান সরকারের সময়ে বাংলাদেশে ব্যাংক লুটপাট যেন নিত্যনৈমত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। নানা অনিয়ম আর দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েও দর্শকের ভূমিকা ছাড়া দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যেন কিছুই করার নেই। সাম্প্রতিক একটি ঘটনা থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্বলতার এমন চিত্র আবারো ফুটে উঠেছে।
গত ২৬ জুলাই রাষ্ট্রখাতের জনতা ব্যাংকের তিনটি শাখা-জনতা ভবন কর্পোরেট শাখা, ঢাকা; লোকাল অফিস, ঢাকা; এবং সাধারণ বীমা ভবন কর্পোরেট শাখা, চট্টগ্রাম এর বৈদেশিক বাণিজ্য অর্থায়ন স্থগিত করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এই তিন শাখায় গুরতর অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়। এর মধ্যে অন্যতম হলো- ইডিএফ (এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড) লোনে অনিয়ম। দেশের রিজার্ভ থেকে সরাসরি অর্থ নিয়ে এই ফান্ড তৈরি করা হয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের রিজার্ভ কমে ৩৯.৫০ বিলিয়নে দাঁড়িয়েছ। তবে এই ৩৯ বিলিয়নের মধ্যে থেকে সাড়ে ৭ বিলিয়ন ইডিএফ লোন হিসেবে রপ্তানিকারকদের দেওয়া হয়েছে। যা বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ হিসেবে গণনা করছে। যদিও আইএমএফ এই হিসাবে আপত্তি জানিয়েছে।
জনতা ব্যাংকের তিনটি শাখা থেকে রপ্তানিকারকরা ইডিএফ লোন নিয়ে এলসি করলেও সেই পন্য দেশে এসেছে কিনা ব্যাংক তা নিশ্চিত করেনি। এছাড়া ডলারে লোন নিয়ে তা ডলারে পরিশোধ করেনি, যার প্রভাব পড়েছে দেশের ফরেন কারেন্সি রিজার্ভে। এই শাখা তিনটির মাধ্যমে এভাবে অর্থায়নে অর্থ পাচারের ঝুঁকি আছে বলে এক চিঠিতে উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেননা, ব্যাক টু ব্যাক এলসির মূল্য পরিশোধ করার পরও রপ্তানি মুল্য দেশে আসেনি। যা গুরুতর অনিয়ম।
২৬ জুলাই জনতা ব্যাংকের এমডি আব্দুস সালাম আজাদকে ( এই এমডির বিরুদ্ধে অ্যাননটেক্স ও ক্রিসেন্ট ঋণ অনিয়মের অভিযোগ আছে) চিঠি দিয়ে ওই শাখা তিনটির বৈদেশিক বানিজ্য অর্থায়ন স্থগিত করা হয়। কিম্তু তার পরের দিনই বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সাথে দেখা করতে যান এমডি। এমডির সাথে মিটিং এর পরেই নতুন করে আরেকটি চিঠি পাঠানো হয় জনতা ব্যাংকে। চিঠিতে পূর্বের শাখা স্থগিতের বিষয়টি রাখা হয়নি। অর্থাৎ ব্যাংকটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে ২৪ ঘন্টাও রাখতে পারলো না কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব কারণে ব্যাংকটির তিন শাখার বৈদেশিক ঋণ কার্যক্রম বন্ধ করে তার মধ্যে অন্যতম হলো চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত নতুন ১০ হাজার ২৮০ কোটি টাকা ঋণের ৮৪ শতাংশই সৃষ্টি হয়েছে নন-ফান্ডেড দায় থেকে। অর্থাৎ ব্যাংকটি ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্র খুলে বা রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল থেকে যে ঋণ দিয়েছে, তার দায় বৈদেশিক মুদ্রায় শোধ করেনি গ্রাহকেরা। ফলে ব্যাংকটি বাধ্য হয়ে ওই গ্রাহকের নামে টাকা ঋণ সৃষ্টি করেছে। ব্যাংকটির এমন ঋণের পরিমাণ ১০ হাজার ৩০ কোটি টাকা। আর ব্যাংকটির ফোর্সড ও ফান্ডেড ঋণ ১৯ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা।
ঋণ কার্যক্রম স্থগিতের চিঠিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, এসব ঋণ স্বাভাবিক ব্যাংকিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সৃষ্টি হয়নি। রপ্তানি মূল্য প্রত্যাবাসন না হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে এবং এই প্রক্রিয়ায় মাধ্যমে অর্থ পাচার হওয়ায় ঝুঁকি রয়েছে।
ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল বা ইডিএফ থেকে দেওয়া ঋণের বিপরীতে রপ্তানি আয় প্রত্যাবাসন হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত না হয়েই বারবার একই গ্রাহককে ইডিএফ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে ইডিএফ-সুবিধার অপব্যবহার করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ইডিএফ গঠন করা হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অর্থ দিয়ে। ডলার-সংকটে ইডিএফ থেকে ঋণ নেওয়া কঠিন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যেসব গ্রাহক ডলারে ঋণ নিয়ে ডলার শোধ করছেন না, তাদের ইডিএফ-সুবিধা বাতিল করা হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, ব্যাংকটির ১৭ বড় গ্রাহকের ফান্ডেড দায় ২৯ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০ হাজার ৩৪ কোটি টাকা এসেছে ঋণপত্র ও নন-ফান্ডেড দায় থেকে। এর মধ্যে ক্রিসেন্ট ও অ্যাননটেক্স গ্রুপের ঋণের ক্ষেত্রে অনিয়ম ও জালিয়াতি ধরা পড়েছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে চিঠিতে বলা হয়, তিন শাখার বৈদেশিক বাণিজ্য অর্থায়ন আপাতত স্থগিত করা হলো। বৈদেশিক ঋণের বিপরীতে ঋণপত্র খোলাও স্থগিত করা হলো।
জনতা ব্যাংকের এই তিন শাখায় রয়েছে প্রভাবশালী ব্যাংকলুটেরা কয়েকটি গ্রুপ। যার মধ্যে, চট্টগ্রামভিক্তিক এসঅালম গ্রুপ যাদের দখলে ৮ থেকে ৯ টি ব্যাংক ও অার্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। অাছে ওরিয়ন গ্রুপ, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাত বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রপ, অর্থপাচারকারী অ্যাননটেক্স ও ক্রিসেন্ট লেদার।
বাংলাদেশ ব্যাংক শুধু জনতা ব্যাংকের বিরুদ্ধে নেওয়া ব্যবস্থা প্রত্যাহার করেই পার পায়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে কর্মকর্তা ওই চিঠি ইস্যু করেছেন তাকেও অন্য ডিপার্টমেন্টে ওইদিনই বদলি করতে হয়েছে।
এই তিন শাখার মধ্যে লোকাল অফিসের গ্রাহক কয়েকটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান, অ্যাননটেক্স ও প্রভাবশালী কয়েকজন গ্রাহক। এই শাখার ২৫ শতাংশ ঋণই খেলাপি। ভবন শাখার গ্রাহক সরকারের উচ্চপর্যায়ের একজন, ক্রিসেন্ট গ্রুপ। এই শাখার ৩০ শতাংশ ঋণই খেলাপি। চট্টগ্রামের সাধারণ বীমা ভবন শাখার গ্রাহক দেশের কয়েকটি ব্যাংকের মালিকের প্রতিষ্ঠান।
ওরিয়ন গ্রপের বিদেশি ঋণের বিপরিতে ৩১৮ কোটি টাকা মুল্যের এসবিএলসি ইস্যু করে কিছুদিন আগেই বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করেছে ব্যাংকটি।
মুলত এসব গ্রুপকে নানা অনৈতিক সুবিধা দিয়ে বছরের পর বছর এমডি হিসেবে টিকে আছেন আব্দুস সালাম আজাদ। জনতার আমানতের টাকা আর দেশের রিজার্ভ ধ্বংস করে ব্যাংক লুটপাটকারীদের অর্থপাচারে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংক শুধু জনতা ব্যাংকের বিরুদ্ধে নেওয়া ব্যবস্থা প্রত্যাহার করেই পার পায়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে কর্মকর্তা ওই চিঠি ইস্যু করেছেন তাকেও অন্য ডিপার্টমেন্টে ওইদিনই বদলি করতে হয়েছে।
জানা যায়, গত বছর শেষে জনতা ব্যাংকের আমানত ছিল ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা। ২৬ জুলাই যা কমে হয়েছে ৯৭ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা। আমানত কমলেও ঋণ বাড়িয়েছে ব্যাংকটি। গত বছর শেষে ব্যাংকটির ঋণ ছিল ৬৯ হাজার ৮৪৯ কোটি টাকা, মঙ্গলবার যা বেড়ে হয়েছে ৭৭ হাজার ৩০৫ কোটি টাকা।
গত বছর শেষে বিল, বন্ড, সুকুক, শেয়ারবাজারসহ বিভিন্ন পণ্যে ব্যাংকটির বিনিয়োগ ৩৫ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা ছিল। যা কমে হয়েছে ২৯ হাজার ২৯২ কোটি টাকা। তবে মেয়াদি বিনিয়োগ বাড়িয়েছে ব্যাংকটি। গত বছর শেষে মেয়াদি বিনিয়োগ ছিল ২ হাজার ২১৮ কোটি টাকা, যা বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা।
গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর ব্যাংকটি অন্য ব্যাংককে ১ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা ধার দিয়েছিল। আর ব্যাংকটি বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্য ব্যাংক থেকে ধার করেছে পাঁচ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা। গত মে মাস থেকে প্রতিদিন একই পরিমাণ টাকা ধার করে আসছে ব্যাংকটি।
একের পর এক নিয়ম লঙ্ঘন করে জনতা ব্যাংক থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়ে একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় রাতারাতি ‘বড়লোক’ হয়েছেন। একই সাথে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িতরাও প্রত্যেকে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ নয়, তালগাছ হয়েছেন। ফলে সরকারি ব্যাংকটির অবস্থা এখন বেগতিক। বারবার সরকার থেকে মূলধন ঘাটতি মেটাতে প্রণোদনা দিয়েও যেন ব্যাংকটির স্বাভাবিক কার্যক্রম ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে জনতা ব্যাংক ডুবতে আর বেশি দেরি হবে না। কোনো জবাবদিহিতা না থাকায় অপরাধীরা বারবার পার পেয়ে গেছে। মূলত শাস্তি না হওয়ায় জনতা ব্যাংকসহ পুরো ব্যাংকিং সেক্টরে বর্তমানে অরাজকতা বিরাজ করছে।
এসব অনিয়মের মূল কারণ, আগের দোষীদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা না নেয়া। বিচারহীনতার একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠছে। শুধু ব্যাংককে শাস্তি দিয়ে লাভ হবে না। যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করে কঠিন শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
জুলকারনাইন সায়ের (সামি), অনুসন্ধানী সাংবাদিক
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৫০
আপনার মতামত জানানঃ