
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংস্কারের প্রশ্নে সম্প্রতি বিএনপিকে ঘিরে বিতর্ক ও প্রচারণা তীব্র হয়েছে। দলটি অভিযোগ করছে, একটি চক্র পরিকল্পিতভাবে তাদের সংস্কারবিরোধী হিসেবে চিত্রিত করতে চাইছে। গুলশানে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ বিষয়ে কঠোর ভাষায় কথা বলেন। তিনি জানান, কিছু গোষ্ঠী মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে, তবে জনগণ এতে সাড়া দিচ্ছে না।
সংস্কার নিয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে অভিযোগ তখনই উঠল যখন জাতীয় ঐকমত্য কমিশন শেষ ধাপের আলোচনায় প্রবেশ করেছে। বিশেষ করে নবগঠিত দল এনসিপির অভিযোগ—বিএনপি ও সমমনা কয়েকটি দলের জন্য মৌলিক সংস্কার থমকে গেছে। জামায়াতে ইসলামীর প্রাক্তন নেতাদের নেতৃত্বে থাকা এবি পার্টির এক সদস্য আরও সরাসরি বলেন, পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা থাকা সত্ত্বেও কোনো একটি পক্ষ বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি একদিকে সংস্কারের প্রতি সমর্থন দেখালেও তাদের আচরণ ও বক্তব্যে কিছু দ্বিধা দেখা যাচ্ছে। বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, বিএনপি অনেক সংস্কার বিষয়ক সিদ্ধান্তকে নির্বাচিত সরকারের ওপর ছেড়ে দিতে চায়, যা অনেকের মধ্যে সংশয় তৈরি করছে—যদি তারা সরকারে গিয়ে আর এগুলো বাস্তবায়ন না করে। আরেক বিশ্লেষক মাহবুব উল্লাহর মতে, বিএনপির সম্ভাব্য নির্বাচনি সাফল্য ঠেকাতে এখন থেকেই অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।
তবে বিএনপির দাবি—সংস্কার প্রশ্নে তারা একগুচ্ছ প্রস্তাব ও ছাড় দিয়ে কমিশনের সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছে। দলটি তাদের পূর্ববর্তী নীতি দলিলগুলো, যেমন ভিশন ২০৩০, ২৭ দফা ও ৩১ দফা তুলে ধরে বলেছে, তাদের সংস্কারবিরোধী বলার সুযোগ নেই। তারা উল্লেখ করেছে, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ ও প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নির্ধারণের প্রশ্নে তারা গুরুত্বপূর্ণ ছাড় দিয়েছে।
তাদের দাবি অনুসারে, তারা নির্বাচন কমিশন, দুদক, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ ও সংবিধান সংস্কার কমিশনের অনেক প্রস্তাবে একমত হয়েছে—যার সংখ্যা কয়েকশ। এমনকি বিরোধী দলকে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির পদ দেওয়ার প্রস্তাবেও তারা রাজি হয়েছে।
কিন্তু এ অবস্থানের মধ্যেও কিছু বিষয় স্পষ্ট। বিএনপি সংবিধান সংশোধন বা প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানো বিষয়ে একধরনের দ্বিধা বা রক্ষণশীলতা প্রকাশ করেছে। তারা মনে করে, নির্বাচিত সংসদেই এসব বিষয়ের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হওয়া উচিত। ফলে অন্য দলগুলোর প্রস্তাব ও বিএনপির আপত্তির কারণে ‘সংস্কারে অনীহা’ ধারণা তৈরি হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি এও বলেছে, কিছু প্রস্তাব এমনভাবে আসছে, যা জনগণের প্রতিনিধি ছাড়াই রাষ্ট্র কাঠামোতে বড় পরিবর্তন আনতে চায়—এতে ফ্যাসিবাদ কায়েমের ঝুঁকি তৈরি হয় এবং রাষ্ট্র দুর্বল হয়ে পড়ে। এই বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়, বিএনপি সংস্কারের নামে কিছু গোষ্ঠীর অতিরিক্ত ক্ষমতা কেন্দ্রিক পদক্ষেপে উদ্বিগ্ন।
সংবাদ সম্মেলনে ‘জুলাই সনদ’ নিয়েও দলের অবস্থান স্পষ্ট করা হয়। মির্জা ফখরুল জানান, দলটি আগেই তাদের অবস্থান জানিয়েছে এবং আলোচনা চালিয়ে যেতে প্রস্তুত। তবে নতুন করে যে সব প্রস্তাব উঠছে, সেগুলো নিয়ে দলটি সতর্ক।
এছাড়া ‘আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি (PR)’ নিয়েও দলটির আপত্তি রয়েছে। স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, এমন পরিবর্তন গোটা নির্বাচনি কাঠামো পাল্টে দেবে এবং জনগণের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা হয়নি।
সবশেষে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিএনপি হয়তো নিজেদের রাজনৈতিক জায়গা ধরে রাখার কৌশলে সংস্কারের প্রশ্নে কিছু ‘পজিশনিং’ নিচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, নির্বাচনে ভালো করতে পারলে তারা সংস্কার করবে—এই অবস্থান থেকেই হয়তো আপাতত সময়ক্ষেপণ করছে দলটি।
এই বিতর্কের মূল বিষয় হলো—সংস্কার কি শুধু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের হাতিয়ার, না কি সত্যিকারের পরিবর্তনের চেষ্টা? বিএনপি সংস্কার প্রশ্নে একাধিক জায়গায় সমর্থন ও ছাড় দিলেও কিছু বিষয়ে অনমনীয় অবস্থান রাখছে। আর এই দ্বৈত অবস্থানকেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও বিশ্লেষকরা সন্দেহের চোখে দেখছেন। সামনে নির্বাচন, আর এ সময়ের সংস্কার বিতর্ক—বাংলাদেশের রাজনীতিতে বড় ধরনের জটিলতা ও দ্বন্দ্বের ইঙ্গিত দিচ্ছে। নির্বাচন হবে কি না, হলেও কেমন হবে—তা নিয়ে জনগণের মধ্যে নতুন করে সংশয় তৈরি হওয়াও বিচিত্র নয়।
আপনার মতামত জানানঃ