রুহুল আমিন নামে এক আওয়ামী লীগ নেতা দীর্ঘ ১০ বছর ধরে মালয়েশিয়ায় বসবাস করে আসছেন। শাহআলম এলাকায় তার দুটি রেস্টুরেন্ট রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তার দুটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানই বেদখল হয়ে যায়। আইনি ঝামেলা এড়াতে তিনি দখলবাজদের সঙ্গে আপসের চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন। তা ছাড়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানারও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও হাত ছাড়া হয়ে গেছে। এসব দখলের পেছনে বিএনপির কতিপয় নেতা সম্পৃক্ত বলে সরেজমিনে তথ্য পাওয়া গেছে।
বিগত সরকারের আমলে মালয়েশিয়ায় প্রবাসীদের পাসপোর্ট সেবা প্রদানে দায়িত্ব পায় ইএসকেএল নামে বেসরকারি একটি কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানটি নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে দরপত্র ছাড়াই ট্রাভেল পাস, ই-পাসপোর্ট এবং এনআইডির মতো স্পর্শকাতর কাজ করত। কোম্পানির অঘোষিত চেয়ারম্যান শেখ রেহানা।
অভিযোগ উঠেছে, ট্রাভেল পাস, ই-পাসপোর্ট এবং এনআইডি সংক্রান্ত সেবাদানের পূর্ব কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না কোম্পানিটির। বাংলাদেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির মালিকানা দখল হয়ে যায়। বিএনপির কয়েকজন নেতা মিলে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করছেন বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে জানায়, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে মালয়েশিয়া দলটির অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে নতুন করে দেখা দেয় আতঙ্ক। অনেকে ব্যবসা-বাণিজ্য ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে। আবার কারওর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান প্রভাব খাঁটিয়ে অন্যরা দখলেও নেয়। স্থানীয় নেতাদের পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রভাবশালী নেতারাও মালয়েশিয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যের কারবার চালাচ্ছে। বিশেষ করে শেখ রেহানাসহ আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী-এমপিরাও আছেন এই তালিকায়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর, পুত্রজায়া, শাহআলম. মালেকা, আলোর সেতার, মিরি, ও সেরেমবান এলাকায় বাংলাদেশিদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সবচেয়ে বেশি। কুয়ালালামপুরের বারজায়া টাইম স্কয়ার মার্কেটে সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম হাজারী, আলাউদ্দিন নাসিম, সাইফুজ্জামান চৌধুরী, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মকবুল হোসেন মুকুল, আক্তার হোসেন, কাইয়ুম সরকার, মনিরুজ্জামান মনির, জালান উদ্দিন সেলিম, সাখাওয়াত হক জোসেফ ও শওকত আলীর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে।
নামপ্রকাশ না করে টাইম স্কয়ারের কয়েকজন ব্যবসায়ী দেশ রূপান্তরকে বলেন, মার্কেটের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় সাতটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর স্থানীয় একটি রাজনৈতিক দলের কতিপয় নেতারা ব্যবসাগুলো দখলে নিয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার পরিবারের নামে টাইম স্কয়ারে ফ্ল্যাট রয়েছে। কয়েক মাস আগে দুটি ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়েছেন।
প্রবাসী বাংলাদেশিরা আরও বলেন, সালমান এফ রহমানের নামে-বেনামে সম্পদ, বিনিয়োগ ও ব্যবসা আছে মালয়েশিয়ার বিভিন্ন স্থানে। এসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আর তারা দেখাশোনা করছে না। আওয়ামী লীগ বিরোধী কতিপয় নেতা দখলে নিয়ে ব্যবসা কার্যক্রম চালাচ্ছেন বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি।
স্থানীয় সূত্র জানায়, দখলের পাশাপাশি নানা অনিয়মের কারণে মাস দু-এক আগে মালয়েশিয়ায় ৯ বাংলাদেশি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সিলগালা করেছে কুয়ালালামপুর সিটি করপোরেশনের (ডিবিকেএল) এনফোর্সমেন্ট ডিপার্টমেন্ট। কুয়ালালামপুরের বারজায়া টাইমস স্কয়ার, জালান ইম্বি এবং বুকিত বিনতাংয়ে অভিযান চালিয়ে এগুলো সিলগালা করে দেওয়া হয়। বাংলাদেশি মালিকানাধীন এসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বৈধ কোনো ব্যবসায়িক কাগজপত্র ছিল না।
বাংলাদেশি মালিকানাধীন পোশাক, ব্যাগ, মোবাইল ফোন সরঞ্জাম, রেস্টুরেন্টসহ ১০টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে অভিযান চালানো হয়। এই সময় ৯টি প্রতিষ্ঠানই তাদের বৈধ ব্যবসায়িক কাগজপত্র দেখাতে ব্যর্থ হওয়ায় দেশটির স্থানীয় সরকার আইন ১৯৭৬-এর ১০১ (১) (ভি) অনুযায়ী তাৎক্ষণিকভাবে এগুলো বন্ধ করে দেয়। এখনো এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা রয়েছেন।
বিগত সরকারের আমলে মালয়েশিয়ায় প্রবাসীদের পাসপোর্ট সেবা প্রদানে কোনোরকম নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে দরপত্র ছাড়াই ট্রাভেল পাস, ই-পাসপোর্ট এবং এনআইডির মতো স্পর্শকাতর কাজের দায়িত্ব পায় ইএসকেএল নামে বেসরকারি একটি কোম্পানি। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রভাব খাঁটিয়ে শেখ রেহানা এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নেন। ওই সময় এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম উদ্বোধন করেন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন।
অভিযোগ উঠেছে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির মালিকানা দখল হয়ে যায়। বিএনপির কয়েকজন নেতা মিলে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করছেন। তার মধ্যে এক নেতা নিজেকে থাইল্যান্ডের নাগরিক পরিচয় দিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি আমেরিকার নাগরিক বলে কাগজপত্র জমা দিয়েছেন। ওই নেতা বাংলাদেশেও ব্যবসা কার্যক্রম চালাচ্ছে বলে প্রবাসীরা জানিয়েছেন।
সাবেক এমপি নাজমুল হাসান পাপন, মুহিবুর রহমান, টিপু মুনশী, স্বপন ভট্টাচার্য, মাহাবুব আরা গিনি, শাহরিয়ার আলম, রেজোয়ান আহমেদ তৌফিক, ইকবালুর রহিম, শেখ হেলাল ইদ্দীন, শেখ তন্ময়, নুরুন্নবী চৌধুরী, আবুল হাসনাত আবদুল্লাহরও মালয়েশিয়া কয়েকটি স্থানে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। তারা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও কিছু বাসস্থান বিক্রি করে দিয়েছেন।
ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কয়েকজন প্রবাসী ব্যবসায়ী দেশ রূপাস্তরকে বলেন, ইএসকেএল প্রতিষ্ঠানটি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানা ও তাদের ফুপাতো ভাই ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরীর ছেলে এবং সাবেক চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটনের মালিকানাধীন। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শেখ পরিবার কয়েক হাজার কোটি টাকা মালয়েশিয়া হয়ে লন্ডন এবং আমেরিকায় পাচার করেছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শেখ রেহানা সরাসরি জড়িত থাকায় হাইকমিশনারের কর্মকর্তারা সব ধরনের সহায়তা করেছেন।
চলতি বছরের ১৮ এপ্রিল মালয়েশিয়ায় বসবাসরত বাংলাদেশিদের ই-পাসপোর্ট ও ভিসা সেবা প্রদান কার্যক্রম ইএসকেএল অফিস, সাউথগেইট কমার্শিয়াল সেন্টার নতুন করে উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনের পরেই দূতাবাসের পাসপোর্ট সার্ভিস সেন্টার থেকে সরকারি সার্ভারসহ যাবতীয় যন্ত্রপাতি ইএসকেএল কোম্পানির অফিসে স্থানান্তর করা হয়।
প্রবাসীরা আরও জানান, চুক্তি অনুসারে, ইএসকেএল কোম্পানির কর্মচারী কর্র্তৃক পাসপোর্ট সার্ভিস সেন্টারে ই-পাসপোর্ট আবেদন জমা ও বায়োমেট্রিক সম্পন্ন করার কথা থাকলেও তা করা হচ্ছে না। শেখ পরিবারের ঘনিষ্ঠ চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটন ও তার ভাই নিক্সন চৌধুরীও এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।
কুয়ালালামপুরে একটি রেস্টুরেন্টের মালিক দেশ রূপান্তরকে জানান, নামে-বেনামে অনেক আওয়ামী লীগ নেতার নামি-দামি রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এসব রেস্টুরেন্টে বাংলাদেশ থেকে আসা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতারা আসা-যাওয়া করতেন। এখনো অনেকে আসছেন। রেস্টুরেন্টগুলো টুইন টাওয়ার ও টাইম স্কয়ারের আশপাশে করা হয়েছে। তা ছাড়া কিছু নেতার স্পা সেন্টারও আছে। তবে এসব প্রতিষ্ঠানগুলো বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আঁতাত করে ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালিয়ে আসছে।
আপনার মতামত জানানঃ