ভারতের আসাম ও সীমান্ত রাজ্যগুলোতে মুসলিম নাগরিকদের বাংলাদেশে ‘ফেরত পাঠানো’ নিয়ে সাম্প্রতিক ঘটনায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তীব্র উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। এসব ঘটনায় ভারতের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চিত্র যেমন স্পষ্ট, তেমনি তা বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্কেও নতুন করে প্রশ্ন তোলে।
গত ৩১ মে, ভারতের আসামের মরিগাঁও জেলার একটি ভাড়া বাসা থেকে আলি নামের ৬৭ বছর বয়সী এক সাইকেল মেকানিককে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। কিছুদিন পর তিনি নিজ ঘরে ফিরলেও এর মাঝে তিনি যে অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গেছেন তা কল্পনাতীত। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাকে ও আরও ১৩ জনকে সীমান্তে নিয়ে গিয়ে বাংলাদেশে ঢুকতে বাধ্য করার চেষ্টা করে। তবে বিজিবি ও স্থানীয়রা জানিয়ে দেয়, তারা ভারতীয় নাগরিক, তাই বাংলাদেশে নেওয়া যাবে না। সীমান্তের নো-ম্যানস ল্যান্ডে এই ১৪ জন আধা-দিনেরও বেশি সময় পানিতে দাঁড়িয়ে, কোনো আশ্রয় ও খাবার ছাড়াই কাটান। আলির কাঁদা মাটিতে বসে থাকা একটি ছবি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়, যেখানে তিনি বলেন, “আমরা নীল আকাশের নিচে নরক দেখেছি।”
আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা ঘোষণা দিয়েছেন, মে মাস থেকে এ পর্যন্ত ৩০০-র বেশি মুসলিমকে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে এবং এই প্রক্রিয়া আরও জোরদার করা হবে। অথচ এইসব ‘ফেরত পাঠানো’ ব্যক্তিদের অধিকাংশই আসামের স্থায়ী নাগরিক, যাদের পরিবার শত বছর ধরে সেখানেই বসবাস করছে। অনেকে ব্রিটিশ আমলের জমির দলিল, সরকারি চাকরির প্রমাণ, এমনকি এনআরসির বৈধ তালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশি তকমা পেয়ে সীমান্তে ফেলে দেওয়া হচ্ছে।
৫৯ বছর বয়সী শোনা বানু বলেন, “যে দেশে আমি জন্মেছি, সেই দেশই আমাকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিল।” আর শিক্ষক খায়রুল ইসলাম জানান, তাকে ২০১৬ সালে বিদেশি ঘোষণা করা হয়, যদিও তার সব নথিপত্র রয়েছে এবং তিনি সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেছেন।
৫০ বছর বয়সী নিজাম আহমেদের নাম জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (NRC)-এ থাকলেও তাকেও সীমান্তে পাঠানো হয়। তার ছেলে জানান, তাদের দাদা আসাম পুলিশ ব্যাটালিয়নের সদস্য ছিলেন। এমনকি পশ্চিমবঙ্গ, গুজরাট, মহারাষ্ট্রের মতো অন্যান্য রাজ্যেও একই ধরণের অভিযানে মুসলিমদের টার্গেট করা হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হস্তক্ষেপে মহারাষ্ট্রে আটক ৭ মুসলিমকে মুক্ত করতে বাধ্য হতে হয় পুলিশকে।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “শুধু বাংলা ভাষায় কথা বলে বলেই তাদের বাংলাদেশি বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে।” মিরানুল শেখ নামের এক ভুক্তভোগী জানান, বিএসএফ তাদের বলেছিল যদি ফিরে আসে তাহলে গুলি করে মারা হবে।
মানবাধিকার সংগঠন ও আইনজীবীরা বলছেন, ভারতের ১৯৫০ সালের আইনের যেই ধারায় এ সব নাগরিকদের অবৈধ ঘোষণা করে ফেরত পাঠানো হচ্ছে, তা কেবল সত্যিকারের অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অথচ, এদের অনেকেই ভারতীয় হিসেবে জন্মসূত্রে স্বীকৃত এবং দফায় দফায় কাগজপত্র দেখিয়েছেন। আলি বলেন, “আমাদের ২০ থেকে ৩০টা কাগজ দেখাতে হয়, অথচ হিন্দুরা শুধু বলে—তারা হিন্দু, তাহলেই চলে।”
ভারতের ২০১৯ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনে (CAA) হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসি ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদেরকে বৈধতা দেওয়া হয়, যদি তারা দাবি করে ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার। তবে মুসলিমদের কোনো স্বীকৃতি নেই। এই বৈষম্যপূর্ণ আইনের ফলে মুসলিমরা নাগরিক হয়েও রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ছে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো ইতোমধ্যে ভারতের এসব কর্মকাণ্ডের তীব্র সমালোচনা করেছে। তারা বলছে, ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব যাচাই এবং মুসলিমদের টার্গেট করে সীমান্তে ঠেলে দেওয়া জাতিগত নির্মূলের এক ছদ্মরূপ। একইসাথে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও এর বিরুদ্ধে আরও কার্যকর কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশের সীমান্তে এমনভাবে ভারতীয় মুসলিমদের জোর করে পাঠানো হলে তা শুধু মানবিক সঙ্কটই নয়, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে চরম উত্তেজনা ডেকে আনতে পারে। বিজিবি ও স্থানীয়দের সক্রিয় ভূমিকা হয়তো তাৎক্ষণিকভাবে এই অপচেষ্টা ঠেকাতে সক্ষম হয়েছে, তবে ভারতের রাজ্য পর্যায়ের উগ্র হিন্দুত্ববাদী নীতি চলতে থাকলে, ভবিষ্যতে তা আরও বড় আকারে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ