বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের ৫৪ বছরের ইতিহাসে বিভিন্ন চুক্তি ও সিদ্ধান্তের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে অর্থনীতি ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। স্বাধীনতার পর প্রথম চুক্তি ছিল ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চের মৈত্রী চুক্তি, যা ছিল ২৫ বছরের একটি কৌশলগত ও কূটনৈতিক সহযোগিতা চুক্তি। এই চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতের ভূমিকার স্বীকৃতি ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়। তবে, এই চুক্তিকে কিছু মহল ‘ভারতের আধিপত্যবাদ’ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা বলেও সমালোচনা করেছে।
এরপর, ১৯৭২ সালের ২৮ মার্চ প্রথম দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে আন্তর্জাতিক সীমানার ১৬ কিলোমিটারের মধ্যে পণ্যসামগ্রী বিনিময় ও ট্রানজিট সুবিধা প্রদান করা হয়। চুক্তির অধীনে প্রথম বছরে ১০০ কোটি টাকার পণ্যসামগ্রী বিনিময়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। বাংলাদেশ থেকে ভারতে মাছ, কাঁচা পাট, ফারনেস অয়েল, ন্যাপথাল, জুট ব্যাচিং অয়েল, আধা পাকা গরুর চামড়া, সিল্কের সুতা, তাঁতের তৈরি সুতি দ্রব্য, গুড়, আয়ুর্বেদীয় ওষুধ এবং বইপুস্তক ও সাময়িক পত্রপত্রিকা রপ্তানি করা হয়। অপরদিকে, ভারত থেকে বাংলাদেশে সিমেন্ট, অ্যাসফল্ট, স্টোন, জিপসাম, লাইমস্টোন, তুলার সুতা, কেমিক্যাল ও ওষুধপত্র, মসলা, তামাক, যন্ত্রের খুচরা অংশ, বইপুস্তক ও সাময়িক পত্রপত্রিকা আমদানি করা হয়।
১৯৭২ সালের ১ নভেম্বর প্রথম অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির মাধ্যমে উভয় দেশ তাদের অভ্যন্তরীণ জলপথ ব্যবহার করে পারস্পরিক বাণিজ্য ও পণ্য পরিবহনের জন্য একটি কাঠামো স্থাপন করে। এই কাঠামো ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সংযোগ বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।
১৯৭৩ সালের ৫ জুলাই তিন বছর মেয়াদি একটি বাণিজ্য চুক্তি সই হয় ঢাকাতেই। এই চুক্তির অধীনে প্রথম বছর সাড়ে ৩০ কোটি টাকা করে মোট ৬১ কোটি টাকার পণ্যসামগ্রী উভয় দেশের মধ্যে বিনিময় করা হবে।
এরপর, ১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করার পর ফারাক্কা বাঁধসহ নানা বিষয় নিয়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এরশাদ আমলে সম্পর্কের মধ্যে উত্থান-পতন কম ছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান অনেক ধরনের অগ্রগতি দেখা দেয়। এই সময় রাজনৈতিক সমর্থনও পাওয়া যায়। তবে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে আবারও টানাপোড়েন দেখা দেয়। বাণিজ্যব্যবস্থা নিয়ে পাল্টাপাল্টি ব্যবস্থা নেওয়া হয়, যার প্রতিক্রিয়া অর্থনীতিতে দেখা যায়।
এই ৫৪ বছরে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতের প্রতি বিভিন্ন সুবিধা প্রদান করা হয়েছে, যেমন বাণিজ্যিক সুবিধা, ট্রানজিট সুবিধা, অভ্যন্তরীণ জলপথ ব্যবহার ইত্যাদি। অপরদিকে, ভারতের পক্ষ থেকেও কিছু সুবিধা পাওয়া গেছে, তবে তা বাংলাদেশের প্রত্যাশা অনুযায়ী ছিল না। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের এই ইতিহাসে উত্থান-পতন, চুক্তি ও সিদ্ধান্তের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে অর্থনীতি ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে।
মূলত, ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে জটিল এক মেলবন্ধন। যদিও দুই দেশের মধ্যে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ গভীর, তবুও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কখনো কখনো ভারতের প্রভাব ও শোষণের শিকার হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের বাজারে ভারতীয় পণ্যের প্রবেশাধিকার এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ শিল্প-উৎপাদনের উপর তার প্রভাব দিন দিন বেড়ে চলেছে। ভারতের বড় বড় কোম্পানি ও পণ্য বাংলাদেশে প্রবেশ করে স্থানীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ও ব্যবসায়ীদের প্রতিযোগিতায় কঠিন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। অনেক সময় ভারতীয় পণ্যের দাম বাংলাদেশি পণ্যের তুলনায় অনেক কম থাকে, যা স্থানীয় উৎপাদনকে বাধাগ্রস্ত করে।
আরেকটি বড় দিক হলো ভারত থেকে আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা। বাংলাদেশ কৃষি ও শিল্পখাতের জন্য প্রয়োজনীয় অনেক পণ্য ভারত থেকে আমদানি করে, যা সময়ের সঙ্গে অর্থনৈতিক দিক থেকে অসুস্থ ও অনিয়ন্ত্রিত এক নির্ভরশীলতার জন্ম দিয়েছে। এই নির্ভরশীলতা ভারতের সাথে বাণিজ্যিক লেনদেনে অসমান সমঝোতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অনেক সময় ভারত পণ্য আমদানি ও রপ্তানি নীতি পরিবর্তন করে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নাজুক প্রভাব ফেলে।
বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকার অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণে রাখতেও ভারত বিভিন্ন ধরণের কৌশল প্রয়োগ করে। সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোর ব্যবসায়িক যোগাযোগ ও পণ্য পরিবহনে ভারত নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, যা বাংলাদেশের স্থানীয় ব্যবসায়ীদের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করে। এতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও বিকাশের পথ অনেকটা বাধাগ্রস্ত হয়।
সর্বোপরি, ভারতের প্রতিপক্ষ ও শক্তি হিসেবে উঠতে চাওয়া বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশে বাধা সৃষ্টির জন্য অনেক সময় ভারতের নানামুখী পদক্ষেপ চোখে পড়ে। বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে না দিয়ে, ভারত তার নিজস্ব স্বার্থে শোষণ চালিয়ে যাচ্ছে। তবে বাংলাদেশ সরকার ও জনগণ সচেতন হলে ও বৈশ্বিক সহযোগিতার মাধ্যমে নিজেদের অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্ত করলে এই শোষণ মোকাবেলা করা সম্ভব।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন নিজের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, বৈচিত্র্যময় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও বাণিজ্য নীতির পুনর্মূল্যায়ন এবং স্থানীয় শিল্প ও উৎপাদন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা, যাতে ভারতের একতরফা প্রভাবের বাইরে থেকে স্বাধীন ও সমৃদ্ধিশালী অর্থনীতি গড়ে তোলা যায়।
আপনার মতামত জানানঃ