কাশ্মীরের পুঞ্চ শহরের বাসিন্দা মোহাম্মদ ইকবালের মৃত্যু তাঁর পরিবারের জন্য শুধু এক মর্মান্তিক শোকের কারণই নয়, বরং এক কঠিন সংকটের শুরু। ৭ মে সকালে ভারত–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখায় গোলাগুলির সময় নিহত হন তিনি। এর আগের রাতেই পাকিস্তান এবং পাকিস্তান–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ভারত, যার প্রতিক্রিয়ায় সীমান্ত জুড়ে সংঘর্ষ শুরু হয়।
দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছিলেন ইকবাল। পরিবার বলছে, প্রতিদিনের মতোই সেদিন সকালে তিনি মাদ্রাসায় যাওয়ার জন্য বাড়ি ছেড়েছিলেন, কিন্তু বাড়ি ফিরেছিলেন মৃতদেহ হয়ে।
তার মৃত্যুর পরপরই কিছু ভারতীয় গণমাধ্যমে ইকবালকে ‘সন্ত্রাসী’ বলে প্রচার শুরু হয়। এই দাবির কোনো ভিত্তি নেই বলেই জানিয়েছে পুলিশ, কিন্তু মিডিয়ার সেই বিভ্রান্তিকর প্রচার সামাজিকভাবে ইকবালের পরিবারকে তীব্র চাপে ফেলে দেয়।
ইকবালের ভাই ফারুক আহমেদ বলেন, “আমার ভাই শুধুই একজন শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু শুধুমাত্র দাড়ি আর টুপি দেখে তাঁকে সন্ত্রাসী বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। মৃত মানুষ আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারে না—এটাই সবচেয়ে কষ্টদায়ক।”
এই ঘটনার সময় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক ও সামরিক উত্তেজনা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। পেহেলগামে হামলায় ২৬ জন পর্যটক নিহত হওয়ার ঘটনার পর ভারত পাকিস্তানের দিকে অভিযোগ তোলে, আর পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান তা অস্বীকার করে। এই দ্বন্দ্বের মধ্যেই সীমান্তে লড়াই ছড়িয়ে পড়ে, যার বলি হন ইকবালের মতো সাধারণ মানুষ।
এই সংঘাত কেবল বন্দুকের লড়াইয়ে সীমাবদ্ধ থাকেনি—মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও শুরু হয় তথ্যের যুদ্ধ। অনেকে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে দেয়, এমনকি করাচি বন্দরের ধ্বংস সম্পর্কেও ভুয়া খবর প্রকাশিত হয়, যা পরবর্তীতে ভারত সরকার নিজেই অস্বীকার করে।
নিউজলন্ড্রি নামক স্বাধীন মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক মনীষা পান্ডে বলেন, “টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর মধ্যে দর্শক টানার প্রতিযোগিতা আছে, সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু এবারের মতো এমন দায়িত্বহীন, উগ্র এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিবেশন আমি আগে দেখিনি।”
ফারুক জানান, তাঁর ভাইয়ের জানাজার কিছুক্ষণ পরেই এক আত্মীয় হোয়াটসঅ্যাপে একটি ভিডিও পাঠান, যেখানে একটি জাতীয় টেলিভিশন চ্যানেল দাবি করছে—এক সন্ত্রাসীকে হত্যা করেছে ভারতীয় সেনা, আর স্ক্রিনে ইকবালের ছবি দেখানো হচ্ছে। এরপর থেকে পরিবারটির কাছে একের পর এক ফোন আসতে থাকে—সবাই জানতে চাইছে ইকবাল সন্ত্রাসী ছিলেন কিনা।
এমন সময় যখন পরিবার শোকে পাথর, তখনই শুরু হয় এ ধরনের মিথ্যা প্রচার। তারা তখনো জানত না, কীভাবে মিডিয়ায় তাদের প্রিয়জনের নামকে বিকৃত করা হচ্ছে।
ফারুকের প্রশ্ন, “সংবাদমাধ্যমের কাছে কী প্রমাণ ছিল যে আমার ভাই সন্ত্রাসী? তারা কাদের কাছ থেকে এসব তথ্য পেল?”
এই ঘটনা শুধুই একটি পরিবারকে আঘাত করেনি, বরং বড় প্রশ্ন তুলেছে: যেকোনো তথ্য যাচাই না করেই প্রচার করে দেওয়ার এই সংস্কৃতি সাংবাদিকতার দায়িত্ববোধকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?
আপনার মতামত জানানঃ