নির্বাচন বা ভোট একটা সময় উৎসবের আমেজ ছড়ালেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হয়ে উঠেছে দুশ্চিন্তার বিষয়। কিছু ক্ষেত্রে আতঙ্ক এবং ভয়েরও কারণ হচ্ছে ভোট। এর ব্যতিক্রম ঘটছে না চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) নির্বাচনে। ২৭ জানুয়ারি ২০২১, বুধবার সকাল ৮টা থেকে বিকেলে ৪টা পর্যন্ত ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) মাধ্যমে সিটির ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।
ভোটারদের মধ্যে ভোট নিয়ে আছে শঙ্কা, ভয়। প্রার্থীদেরও আছে শঙ্কা। এই শঙ্কা প্রকাশ করেছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। আওয়ামী লীগ সমর্থিত এক কাউন্সিলর প্রার্থীর বাসায় হামলার ও গুলিবর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
চট্টগ্রাম সিটির ভোটের পুনর্তারিখ নির্ধারণের পর থেকে নির্বাচনি মাঠে চষে বেড়িয়েছেন মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বী সাত জন প্রার্থী। এবার ছয়টি রাজনৈতিক দলের ছয়জন এবং স্বতন্ত্রভাবে একজন মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা হলেন—আওয়ামী লীগের মো. রেজাউল করিম চৌধুরী (নৌকা), বিএনপির শাহাদাত হোসেন (ধানের শীষ), ইসলামী আন্দোলনের মো. জান্নাতুল ইসলাম (হাতপাখা), ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) আবুল মনজুর (আম), বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের এম এ মতিন (মোমবাতি), ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের মুহাম্মদ ওয়াহেদ মুরাদ (চেয়ার) ও স্বতন্ত্র প্রার্থী খোকন চৌধুরী (হাতি)। সাধারণ কাউন্সিলর ১৭২ জন এবং সংরক্ষিত কাউন্সিলর হিসাবে ৫৭ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
২৫ জানুয়ারি, সোমবার চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) নির্বাচনের প্রচারণার শেষ দিনে মিছিলের নগরীতে পরিণত হয় চট্টগ্রাম। জনসমর্থন দেখাতে কাউন্সিলর প্রার্থীদের অনেকেই মিছিল করেছেন নিজ নিজ এলাকায়। নৌকা ও ধানের শীষের পক্ষেও মিছিল হয়েছে ওয়ার্ডে। মাইক বাজিয়ে রাজপথেও সরব ছিল প্রধান দুই মেয়র প্রার্থীর অনুসারীরা। চট্টগ্রামে কাউন্সিলর পদে বিদ্রোহী প্রার্থী থাকায় প্রচারণাও জমজমাট ছিল এবার।
শান্তিপূর্ণ ভোটগ্রহণের সব প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন চসিক নির্বাচনের রিটানিং অফিসার। তিনি বলেছেন, ‘ কোন ধরনের সহিংসতা ছাড়া ভোট গ্রহণ শেষ করা ইসির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলেও শান্তিপূর্ণ সব কার্যক্রমে সফল হবে সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানটি।’
চট্টগ্রাম সিটিতে ভোটার ১৯ লাখ ৩৮ হাজার ৭০৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৯ লাখ ৯২ হাজার ৩৩ জন এবং নারী ভোটার ৯ লাখ ৪৬ হাজার ৬৭৩ জন। একজন মেয়রের পাশাপাশি নগরীর ৪১টি সাধারণ ওয়ার্ডের ৪১ জন সাধারণ কাউন্সিলর, ১৪ জন সংরক্ষিত কাউন্সিলর নির্বাচিত করবেন ভোটাররা। ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ৭৩৫টি এবং ভোটকক্ষ ৪ হাজার ৮৮৬টি।
এদিকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সহিংসতার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। তিনি বলেছেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের কার্যকালের অবশিষ্ট সময়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। এই নির্বাচনকে ঘিরে সহিংসতার শঙ্কা ও উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বিশৃঙ্খল সৃষ্টিকারীদের আইনানুগভাবে অবশ্যই প্রতিহত করতে হবে।
চসিক নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গ্রেপ্তার আতঙ্কে রয়েছেন বিএনপি ও দলটির অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এদিকে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর সমর্থক ও নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নির্বাচন পরিবেশ নষ্ট করার অভিযোগ তুলেছেন বিএনপি। সেই সঙ্গে গভীর রাতে পুলিশ ঢুকে বিএনপির নিরীহ নেতাকর্মীদের বাসায় বাসায় গিয়ে হানাসহ ধরপাকড় করে নিয়ে এসে গায়েবি মামলায় অভিযুক্ত করছে বলে অভিযোগ করছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা।
বিএনপির ৩৪ প্রার্থী ২৩৮ মামলা কাঁধে নিয়ে ভোটের মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। ভাঙচুর, সহিংসতা, হত্যাসহ নানা মামলা আছে তাদের বিরুদ্ধে। সেই তালিকায় মেয়র প্রার্থী নগর বিএনপির আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেনের পাশাপাশি রয়েছেন ৫ নারী ও ২৮ সাধারণ কাউন্সিলর প্রার্থী।
জানা গেছে, রোববার ২৪ জানুয়ারি রাত থেকে বিএনপির নেতাকর্মীদের বাসায় পুলিশের তল্লাশি এবং গ্রেপ্তার অভিযান চলছে। রাত তিনটায় বাকলিয়া এলাকা থেকে বাকলিয়া থানা মহিলা দলের সভানেত্রী মরিয়মকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। মরিয়মের স্বামী বলেছেন, ‘আমার স্ত্রীর নামে কোন মামলা নেই। শুধু বিএনপি করার কারণে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’ এছাড়া নগরীর কোতোয়ালি, পতেঙ্গা, ডবলমুরিং, চাঁন্দগাও থানা এলাকাসহ কয়েকটি এলাকায় বিএনপির নেতাকর্মীদের বাসায় পুলিশি হয়রানি করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে আওয়ামী লীগ বারবার ইসিতে অভিযোগ করেছে, বিএনপি বহিরাগত সন্ত্রাসীদের এনেছে নাশকতা সৃষ্টির জন্য। এদিক বিএনপিও একই অভিযোগ করেছে ইসিতে।
৩৩নং ফিরিঙ্গিবাজার ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী মো. সালাউদ্দিনের বাসায় হামলা চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। সোমবার ভোররাত ৩টার দিকে এ হামলার ঘটনায় নগরের কোতোয়ালি থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়েছে বলে জানান নগর ছাত্রলীগের সাবেক এই সাধারণ সম্পাদক।
মো. সালাউদ্দিন জানান, ‘ঘটনার সময় আমি বাসায় ছিলাম না। খবর পেয়ে দ্রুত বাসায় যাই। পুলিশকে খবর দেয়া হয়। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে শটগানের ৬টি ও পিস্তলের ৩টি গুলির খোসা উদ্ধার করেছে। কাপড়ে মুখ বাঁধা একদল সন্ত্রাসী আমার বাসায় অতর্কিত হামলা চালায়। এ সময় তারা কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে।’
প্রার্থী ও ভোটারদের ভেতর নির্বাচনী সহিংসতাসহ নির্বাচনকেন্দ্রিক অপরাধের যেসব শঙ্কা রয়েছে, তা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখছে নির্বাচন কমিশন। সেজন্য নির্বাচন নির্বিঘ্নে করতে ইসির নির্দেশে নিরাপত্তাবলয় গড়ে তুলেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
সোমবার সকালে ২১নং জামালখান ওয়ার্ডের নতুন ভোটার ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র আরিফ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এই প্রথম ভোট দিব। তাই ভোটের দিনের অপেক্ষায় আছি। অনেক আনন্দ লাগছে ভোট দিব বলে।’
নগরের চাঁন্দগাও আবাসিক এলাকার ভোটার বলেন, ‘এক সময় এই শহরে ভোট এলেই বাড়িতে বাড়িতে উৎসবের আমেজ বয়ে যেত। মেয়েদের বাবার বাড়িতে নাইয়র (বেড়াতে) আনা হতো, গভীর রাত পর্যন্ত চলতো নির্বাচনী আড্ডা। এখন নির্বাচন বললেই মানুষের চেহারায় আতঙ্ক ভর করে। এ নিয়ে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলতে চায় না। সবাই জানে নির্বাচনে কারা জয়ী হবেন; তাই আর ভোট দিতেও উৎসাহী হয় না।’
তিনি বলেন, ‘এবার নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর পর থেকেই হামলা-ভাঙচুরের খবর আসছে, মানুষও মরছে। সাধারণ ভোটাররা কতটুকু কেন্দ্রমুখী হবেন তা সময় বলে দেবে। নির্বাচনে ভোটারদের কেন্দ্রে নিতে হলে আগে ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ ও পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে দেয়ার স্বাধীনতা দিতে হবে।’
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার (সিএমপি) সালেহ মোহাম্মদ তানভীর জানান, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কোন ভোটকেন্দ্রকে আমরা ‘ঝুকিপূর্ণ’ হিসেবে দেখছি না। তবে কিছু ভোটকেন্দ্রকে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। নগরীর ৭২৩টি কেন্দ্রের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৪১০টি কেন্দ্রকে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ও ৩১৩টি কেন্দ্রকে ‘সাধারণ’ হিসেবে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। এদিকে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে বাড়তি কোন ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা জানতে চাইলে নগর পুলিশের বিশেষ শাখার উপকমিশনার (ডিসি) আবদুল ওয়ারিশ জানান, গুরুত্বপূর্ণ’ কেন্দ্রগুলোতে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী সবকিছুই করা হবে।
নির্বাচনে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ, বিজিবি, আনসার ও ভিডিপি দায়িত্ব পালন করবে। সাধারণ ভোটকেন্দ্রে ১৬ জন করে এবং গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে ১৮ জন করে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য নিয়োজিত থাকবেন। মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্সের দায়িত্ব পালন করবে পুলিশ, এপিবিএন, ব্যাটালিয়ন আনসার, বিজিবি ও র্যাব। ইভিএমের কারিগরি সহায়তায় প্রতি ভোটকেন্দ্রে সশস্ত্র বাহিনীর দু’জন করে সদস্য নিয়োগ থাকবেন।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যানবাহন চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে নগর পুলিশ। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি (জনসংযোগ) শাহ মো. আব্দুর রউফ স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
২৬ জনুয়ারি দিবাগত মধ্যরাত ১২টা হতে ২৭ জানুয়ারি মধ্যরাত ১২টা পর্যন্ত ট্রাক, পিক আপ, বেবি ট্যাক্সি/অটোরিকশা/ইজিবাইক, মাইক্রোবাস, কার, জিপ চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ২৫ জানুয়ারি দিবাগত মধ্যরাত ১২টা থেকে ২৮ জানুয়ারি সকাল ৬ টা পর্যন্ত মোটরসাইকেল চলাচলের ওপরও নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে।
এসডব্লিউ/এফএ/১৪৩৫
আপনার মতামত জানানঃ