পলাশীর যুদ্ধ ইতিহাসের বাঁকবদলে যত বড় ভূমিকা বা প্রভাব রেখেছে সে তুলনায় এ যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি ছিল নেহাতই সামান্য। আজকের দিনের যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করলে তা অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। ১৭৫৭ সালের ২ জুলাই মাদ্রাজ কাউন্সিলকে পাঠানো ক্লাইভের বার্তা অনুসারে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বাহিনীর মোট ২২ জন নিহত হয়েছিলেন আর আহত ৫০ জন। এর মধ্যে বাদামি গাত্রবর্ণের সদস্যরাই বেশি নিহত হন। ঐতিহাসিক রবার্ট ওরমে জানান, ২০ জন ইউরোপীয় নিহত অথবা আহত হয়েছিলেন। সিপাহি মারা যান ১৬ জন, আহত হন ৩৬ জন। ব্রিটিশ কর্মকর্তা আহত হয়েছিলেন মাত্র দুজন। এ দুজন ছিলেন গোলন্দাজ শাখার, তবে তারা কোন শাখার ছিলেন তা নিয়ে মতভেদ আছে।
পলাশীর যুদ্ধের পর ১৭৫৭ সালের ৩ আগস্ট ক্লাইভের বাহিনী মুর্শিদাবাদ ফিরে আসে। তখন ইউনিট ধরে আহত-নিহতদের তালিকা করা হয়। এ তালিকা অনুসারে নিহতদের মধ্যে মাদ্রাজ আর্টিলারির ছিল তিনজন, একজন মাদ্রাজ রেজিমেন্টের ও একজন বেঙ্গল ইউরোপিয়ান। বিভিন্ন র্যাংকের আরো ১৫ সদস্য আহত হয়েছিলেন। এদের মধ্যে ৩৯ রেজিমেন্টের চারজন, মাদ্রাজ রেজিমেন্টের তিনজন, বেঙ্গল ইউরোপীয় দুজন, মাদ্রাজ আর্টিলারির চারজন, একজন বেঙ্গল আর্টিলারির এবং একজন বোম্বের রেজিমেন্টের। তালিকায় আহত তিনজন কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করা হয়েছে—বেঙ্গল ইউরোপিয়ান রেজিমেন্টের লেফটেন্যান্ট ডি লুবার, বেঙ্গল আর্টিলারির কাসেলস ও হোল্স্ট। জানা যায়, এ হোল্স্ট আহত হয়েছিলেন এবং মারা যান যুদ্ধের কয়েক মাস পরে, তাকে ১৩ নভেম্বর কলকাতায় সমাধিস্থ করা হয়।
মাদ্রাজের চারজন সেনা নিহত হয়েছিলেন, আহত ১৯ জন। আর বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিপাহি নিহত হন নয়জন, আহত ১১ জন। একজন ইউরোপীয় নাবিকও নিহত হয়েছিলেন, তার নাম শোরেডিচ। তিনি ছিলেন এইচএমএস কেন্টের নাবিক। শোরেডিচ আর্টিলারি দলে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। আরো একজন নৌসেনার আহত হওয়ার কথা জানা যায়।
রবার্ট ক্লাইভের হিসাবমতে, পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলা ৫০০ সেনা হারিয়েছিলেন। তবে তার সেনাদলের আকারের তুলনায় এ সংখ্যা বড় নয়। তবে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক নেতা যেমন মীর মদন, বকশী হাজারীর মৃত্যু যুদ্ধের ফলাফলে বড় ভূমিকা রেখেছিল।
বিজয়ী সেনাদল যুদ্ধের ময়দানে অনেকক্ষণ অবস্থান করে। তারা নতুন গরুর গাড়ি সংগ্রহ করে সেগুলোয় আগ্নেয়াস্ত্র বহন করে। রাতে দাউদপুর গ্রামের কাছে শিবির স্থাপন করে। মীর জাফর রাতের বেশিরভাগ সময় পলাশীতেই অবস্থান করেন।
যুদ্ধ শেষে বিকালে ক্লাইভ ফোর্ট উইলিয়াম কমিটি ও ওয়াটসনকে এই বার্তাটি পাঠান— ভদ্রমহোদয়গণ, আজ সকালে আমরা পলাশীর জঙ্গলের কাছে পৌঁছাই। সকালেই নবাবের পুরো সেনাদল আমাদের দৃষ্টিসীমায় চলে আসে। কয়েক ঘণ্টা তারা আমাদের দিকে কামান দাগে। দুপুরের দিকে তারা তাদের শিবিরে ফিরে যায়। সেটাও আমাদের দৃষ্টিসীমায়ই ছিল।
পরে রায়দুর্লভের সংকেতে আমরা অগ্রসর হই এবং নবাবের শিবিরে হামলা চালাই। আমরা তার সব কামান দখল করি এবং ছয় মাইল দূরে তাকে আটক করি। এটা দাউদপুরের কাছে এবং কাল তাকে মুর্শিদাবাদ নেয়া হবে। মীর জাফর, রায়দুর্লভ নিষ্ক্রিয় থাকা ছাড়া আর কোনো সহায়তা করেনি। তারা বড় বাহিনী নিয়ে আমার পক্ষে ছিল। মীর মদন ও ৫০০ ঘোড়সওয়ার নিহত হয়েছে। এছাড়া তিনটি হাতিও নিহত হয়েছে। আমাদের ক্ষতি নেহাতই সামান্য। ২০ জনের বেশি ইউরোপীয় নিহত বা আহত হয়নি।
সে বিকালেই ক্লাইভের হাতে আসে মীর জাফরের অভিনন্দন বার্তা। জাফর ক্লাইভকে ওয়াটস বা দুজন প্রতিনিধিকে পাঠাতে বলেন তার সঙ্গে দেখা করার জন্য। পরের দিন সকালে ক্লাইভ ওমর বেগ ও লুক স্ক্যাফটনকে পাঠান মীর জাফরকে দাউদপুরে নিয়ে আসার জন্য। মীর জাফরকে সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করে ক্লাইভের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। ক্লাইভ তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন এবং নতুন নবাব হিসেবে সম্বোধন করেন।
ক্লাইভ মীর জাফরকে যত দ্রুত সম্ভব রাজধানীর দিকে রওনা হতে বললেন। এদিকে ক্লাইভ কিছুটা পেছনে থেকে মীর জাফরকে অনুসরণ করেন এবং মুর্শিদাবাদে প্রবেশের আগে মেদিনীপুর হাজির হন। ক্লাইভ তার ওপর হামলা বিষয়ে একটি সতর্কবার্তা পেয়েছিলেন। ২৯ জুন যখন তিনি মুর্শিদাবাদ পৌঁছান, তখন তাকে নিরাপত্তা দিচ্ছিল ২০০ ইউরোপীয় সেনা এবং ৩০০ দেশী সিপাহি। বিকালে রাজপ্রাসাদের দরবার কক্ষে ক্লাইভ ও মীর জাফরের সাক্ষাৎ হয়। এখানে রীতিমতো ক্লাইভ মীর জাফরকে নবাব হিসেবে মেনে তাকে কিছু স্বর্ণমুদ্রা নজরানা দেন।
যুদ্ধ শেষে সিরাজ মুর্শিদাবাদে ফিরে যান। নিজের ধনদৌলত দিয়ে সেনাদের সমর্থন চান। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা তাকে ক্লাইভের কাছে আত্মসমর্পণ করতে পরামর্শ দেন। নবাব অতি অবশ্যই তা প্রত্যাখ্যান করেন। মধ্যরাতে তিনি শহরে মীর জাফরের আগমনের বার্তা পেয়ে দ্রুত স্ত্রী লুৎফুন্নেসা ও ঘনিষ্ঠদের নিয়ে রওনা হন, সঙ্গে যতটা সম্ভব স্বর্ণ ও অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী নিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিল হাতি ও আসবাবপত্র।
পথিমধ্যে রাজমহলে তিনি আবার বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হলেন। তাকে আশ্রয় দেয়ার ভান করে সে ব্যক্তি মীর জাফরের ভাইকে খবর পাঠালেন, যিনি সে এলাকার সামরিক গভর্নর। সেখানেই নবাবকে গ্রেফতার করা হলো এবং রাতেই তাকে হত্যা করেন মীর জাফরের পুত্র মীরন। ১৭৫৭ সালের ৩ জুলাই সিরাজউদ্দৌলার মরদেহ হাতির পিঠে করে মুর্শিদাবাদে ঘোরানো হয়। ভাগ্যের পরিহাস বাংলার এ শেষ নবাবকে উদ্ধার করতে তখন পথে ছিল একটি ফরাসি সেনাদল। তারা তখন মুর্শিদাবাদ থেকে দুদিনের দূরত্বে।
আপনার মতামত জানানঃ