ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে ব্যাংক খাত, যা অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এই খাত রক্ষা ও তদারকির দায়িত্ব ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর। ১৫ বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর পদে ছিলেন তিনজন, যাঁদের বিরুদ্ধে অনিয়মের সহযোগী হওয়ার পাশাপাশি অবৈধ অর্থের মালিক হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ সময়ে যাঁরা ডেপুটি গভর্নর (ডিজি), আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা (বিএফআইইউ) ও অন্যান্য শীর্ষ পদে ছিলেন, তাঁদের অনেকেই অনিয়মে সহযোগিতা করার পাশাপাশি সুবিধাভোগী ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গতকাল মঙ্গলবার সাবেক ডিজি সিতাংশু কুমার (এস কে) সুরকে চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করেছে। আদালত তাঁকে জেলহাজতে পাঠিয়েছেন। এর আগে সম্পদের বিবরণী নোটিশের জবাব না দেওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।
জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে চলতি মাসের শুরুতে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) সাবেক প্রধান মাসুদ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। এ ছাড়া সংস্থাটি যাঁকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাত ধ্বংসের কারিগর হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়, সেই নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমের বিরুদ্ধেও অনুসন্ধান করছে। দ্রুতই মামলা হতে পারে বলে জানিয়েছে একটি সূত্র।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিগত সময়ে একটা চক্র গড়ে উঠেছিল। যার পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে তৎকালীন সরকার। এই চক্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারাও ছিলেন। এ জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে, জেলে যেতে হচ্ছে। যাঁরা অনিয়মে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের সবার বিচার নিশ্চিত করতে হবে। নইলে বিচার পরিপূর্ণ হবে না। এতে অন্যরা আবার একই পথে হাঁটবে।’
গতকাল জেলহাজতে পাঠানো এস কে সুর চৌধুরীকে ২০১২ সালের জানুয়ারিতে ডিজি হিসেবে নিয়োগ দেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৮ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত তাঁকে এই দায়িত্বে রাখা হয়। এ সময়ে তিনি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান উভয় খাতের দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর অনুমোদনে একে একে চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান তুলে দেওয়া হয় বহুল আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারের কাছে, যা পরে লুটপাটের শিকার হয়। পাশাপাশি ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (এসআইবিএল) যখন এস আলম গ্রুপ দখল করে, সেই অনুমোদন দেন তিনি আর তৎকালীন গভর্নর ফজলে কবির। কারা এসব ব্যাংক দখল করল, টাকার উৎস কী ছিল, তার কিছুই তখন খতিয়ে দেখেনি নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। পরে ২০১৮ সালে তাঁকেই ব্যাংক খাত সংস্কারের উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। একই সময়ে তাঁর সহযোগী হিসেবে পরিচিত নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম ছিলেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের তদারকির দায়িত্বে। এ জন্য তাঁর অবৈধ অর্থের অনুসন্ধান করছে দুদক।
২০২১ সালের নভেম্বরে ডিজি পদমর্যাদায় বিএফআইইউর প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান মো. মাসুদ বিশ্বাস। কয়েক দফায় মেয়াদ বাড়ানোর পরে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিনি বিদায় নিতে বাধ্য হন। অর্থ পাচার প্রতিরোধের দায়িত্বে থাকলেও তাঁর সময়ে সংস্থাটি কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। উল্টো পাচারকারীদের সহায়তায় নিজের মেয়াদ বাড়ানোর পাশাপাশি অবৈধ সম্পদ গড়ার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
২০২১ সালে ডিজি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া আবু ফরাহ মো. নাছের ঋণ নীতিমালা শিথিলের মাধ্যমে পুরো ব্যাংক খাতকে বিপর্যস্ত করে ফেলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনি হয়ে উঠেছিলেন বেসরকারি খাতের প্রতিনিধি। এ জন্য মেয়াদ শেষে তাঁকেও ব্যাংকিং নীতি উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া ডলার বাজারে বিশৃঙ্খলা তৈরির জন্য ডিজি কাজী ছাইদুর রহমান এবং ব্যাংকগুলো থেকে সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে ডিজি খুরশীদ আলমের বিরুদ্ধে। সরকার পতনের পর তাঁদের তিনজনকেই গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে পদ ছেড়ে যেতে হয়।
এ ছাড়া আওয়ামী লীগ আমলে দায়িত্ব পালন করা একাধিক ডিজি ও নির্বাহী পরিচালক চাকরি শেষে বেক্সিমকো, বসুন্ধরা ও এস আলম গ্রুপে যোগ দেন।
অনিয়মে সহযোগী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র মোহাম্মদ শাহরিয়ার সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ‘যাঁরা অনিয়ম করেছেন, তাঁরা ব্যক্তিগত পর্যায়ে করেছেন। পদ অপব্যবহার করেও সেটা করতে পারেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও কেউ সুবিধাভোগী আছেন কি না, তা খতিয়ে দেখার কোনো উদ্যোগ এখনো নেওয়া হয়নি।’
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর থেকেই ব্যাংক খাতে অনিয়ম শুরু হয়। ২০১৪ সালে দলটি আবার সরকার গঠন করলে ব্যাংক খাতে বেপরোয়া আচরণ শুরু করেন আওয়ামী লীগপন্থী ব্যবসায়ীরা। এই মেয়াদে ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও কমার্স ব্যাংক দখল করে এস আলম গ্রুপ। ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয় সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর পরিবার। আর ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতা নেওয়ার পর যেন রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে ব্যাংকে ব্যাংকে ‘ডাকাতি’ শুরু হয়। কয়েকটি ব্যাংকে তারল্যসংকট দেখা দিলে, তাদের টাকা ছাপিয়ে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেই টাকাও ঋণের নামে লুট হয়ে যায়। গভর্নর ও ডিজিসহ অনেক উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা তখন অতি উৎসাহ দেখান।
২০১১ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকিতে দুর্বলতার সুযোগে সোনালী ব্যাংকে হল–মার্ক জালিয়াতি হয়। এর জেরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরামর্শে সোনালী ব্যাংকের পর্ষদে পরিবর্তন আনে সরকার। তবে একই সময়ে আবার বেসিক ব্যাংকে জালিয়াতি হলেও রাজনৈতিক চাপে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা রুখতে পারেনি।
২০১২ সালে নতুন ব্যাংক অনুমোদনের উদ্যোগ নেওয়া হলে কারা তা পাবেন, সেই তালিকা সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে গভর্নরকে দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী আওয়ামী লীগ নেতাদের ৯টি ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হয়। ২০১৫ সালে আওয়ামী লীগ সভাপতির বেসরকারি উন্নয়নবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের এক চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর নীতিমালায় নানা ছাড় দিয়ে ব্যাংক খাতকে বিপর্যস্ত করে ফেলা হয়।
২০১৬-১৮ সালে যখন ব্যাংকগুলো দখল হয়, তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ও ডিজিসহ যুক্ত কর্মকর্তারা গভীর রাত পর্যন্ত অফিসে থেকে তা অনুমোদন করেন। পরে এসব ব্যাংক লুটপাট হলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চুপ থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অনিয়ম নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে নিয়ন্ত্রণ সংস্থাটি তার প্রতিবাদ করে। যা ব্যাংক অনিয়মে যুক্ত ব্যক্তিদের পক্ষে যায়। বিভিন্ন প্রতিবেদনের জেরে ২০২৪ সালের মার্চ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর যা খুলে দেওয়া হয়।
এখন অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যাংক খাত সংস্কার করা। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি ব্যাংক খাতকে কৃষ্ণগহ্বরের (ব্ল্যাকহোল) সঙ্গে তুলনা করেছে।
কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ব্যাংক খাতে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ এখন ৬ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। খাতটি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। রাষ্ট্রীয় সংস্থার সহায়তায় ব্যাংক দখল হয়েছে। একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাতেই আটটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়া হয়। এই সুযোগে বড় অঙ্কের অর্থ দেশের বাইরে পাচার করা হয়। দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংক খাতে তদারকি ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। তবে সব ক্ষেত্রেই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে সংস্থাটি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) পরিচালক শাহ মো. আহসান হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেকোনো অনিয়ম হলে যাঁরা জড়িত, তাঁদের আইনের আওতায় আনতেই হবে। জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনতে না পারলে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরবে না। ফলে উদ্যোগগুলো বিফলে যাবে।’
আপনার মতামত জানানঃ