হঠাৎ যদি বলা হয়, সময় সম্পর্কে আপনার আগেকার ধারণার সবকিছুই ভুল, তাহলে কী হবে? কিছু পদার্থবিদ যুক্তি দিয়েছেন, সময় আসলে এক ধরনের ভ্রান্তি, মায়া বা মানুষের মস্তিষ্কের গভীরে জন্ম নেয়া ধারণা মাত্র, যা প্রকৃতপক্ষে মহাবিশ্বের মৌলিক কোন সত্ত্বা নয়। তবে কি আগামীকাল ইতোমধ্যেই ঘটে গেছে, আর আমরা কি শুধুমাত্র কার্যকারণের (কারণ-পরিণতি) মোহজালে আটকে আছি? আলবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ থেকে শুরু করে কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার যুগান্তকারী তত্ত্বগুলো, সময় সম্পর্কে আমাদের গভীর বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।
সময় কি সত্যিই অস্তিত্বশীল, নাকি এটি কেবল আমাদের উপলব্ধির গভীরে এক ধরনের ভ্রান্তি? ফ্রান্সের এক্স-মার্সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের পথিকৃৎ পদার্থবিদ কার্লো রোভেলি তার বিখ্যাত বই ‘দ্য অর্ডার অফ টাইম’ -এ জানিয়েছেন, সময় সম্পর্কে আমরা এখন পর্যন্ত যা জানি, তার সবই আদতে বড় ধরনের বিভ্রম।
ঘড়ির কাঁটার বিরতীহীনভাবে এগিয়ে যাওয়া বা আইনস্টাইনের মহাকাশ-সময়ের ধারণা ভুলে যান। পদার্থবিদ কার্লো রোভেলির মতে, সময়ের প্রবাহ আদতে আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার ফল, যা মহাবিশ্বের কোনো মৌলিক সত্ত্বা নয়।
শতাব্দীর পর শতাব্দী মানুষ নিউটনের ঘড়ির মতো নির্ভুল মহাবিশ্বের ওপর নির্ভরশীল ছিল, যেখানে সময় বিরামহীনভাবে এগিয়ে যায় এবং এটি সার্বজনীন। এরপর এলেন আলবার্ট আইনস্টাইন। তার বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব প্রমাণ করে, সময় পদার্থ বিজ্ঞানে অস্তিত্বশীল নয়; এটি মাধ্যাকর্ষণ এবং গতির প্রভাবে পরিবর্তিত হয়। কিন্তু রোভেলি আরও একধাপ এগিয়ে দাবি করেন, আইনস্টাইনের মহাকাশ-সময়ের ধারণাও কেবল একটি সরলীকরণ।
তাহলে রোভেলি কী প্রস্তাব করবেন? রোভেলির মতে, মহাবিশ্বের বাস্তবতা তৈরি হয়েছে ঘটনাবলী দিয়ে, বস্তুকণা বা ক্ষেত্র দিয়ে নয়। তার মতে, পদার্থবিজ্ঞানের মূলভিত্তিতে সময় বলে কিছু নেই; এটি সৃষ্ট হয় ঘটনাগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক থেকে। তিনি বলেন, পৃথিবী আদতে একটি সরল সময়রেখার মতো নয়, বরং ঘটনাগুলোর একটি জটিল জালের ভেতর অস্তিত্বশীল।
তাহলে আমরা কেন সময়কে অতীত থেকে ভবিষ্যতের দিকে প্রবাহিত হয় বলে অনুভব করি? রোভেলি এই প্রশ্নের জবাব দেন এনট্রপির মাধ্যমে। থার্মোডাইনামিক্সে লুডউইগ বোল্টজম্যান প্রথম এনট্রপির ধারণা দিয়েছিলেন। এটি মূলত বিশৃঙ্খলার পরিমাপক।
মহাবিশ্ব যখন শৃঙ্খলা থেকে বিশৃঙ্খল অবস্থার দিকে ধাবিত হয়, তখন আমরা সময়ের গতি বা তির অনুভব করি। এই প্রবাহ টের পাওয়ার কারণ হচ্ছে মহাবিশ্বের সব কিছু একসঙ্গে দেখতে না পারার ব্যর্থতা। বস্তুকণা এবং তাদের অবস্থান সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের অভাবের কারণেই আমাদের মনে বিরামহীন ঘড়ির বিভ্রম তৈরি হয়।
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, আমরা গতকালকে মনে করতে পারি কিন্তু আগামীকালকে নয়, কারণ এনট্রপি বাড়ছে এবং তথ্যগুলো মহাবিশ্বে অপরিবর্তনীয়ভাবে ছড়িয়ে যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়া আমাদের সময়ের প্রবাহের ধারণাকে থার্মোডাইনামিক্সের দ্বিতীয় সূত্রের সঙ্গে যুক্ত করে, যা দাবি করে, একটি বিচ্ছিন্ন সিস্টেমে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এনট্রপি বাড়ে।
লুপ কোয়ান্টাম গ্রাভিটির (এলকিউজি) অন্যতম স্রষ্টা হচ্ছেন এই রোভেলি। এটি একটি উচ্চাভিলাষী তত্ত্ব যা কোয়ান্টাম মেকানিক্স এবং আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাকে একীভূত করার চেষ্টা করে। এলকিউজির মূল ধারণা হলো সময়ের অনুপস্থিতি বা অস্তিত্বহীনতা।
কোয়ান্টাম গ্রাভিটির একটি গুরুত্বপূর্ণ সমীকরণ-উইলার-ডি উইট সমীকরণ মহাবিশ্বকে সময় ছাড়াই বর্ণনা করে। এটি সময়কে একটি উদ্ভূত বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখায়, যা ঘটনাগুলোর মধ্যকার কার্যকারণ সম্পর্ক থেকে আসে। রোভেলির মতে, ‘একটি ঝড় কোনো বস্তু নয়; এটি ঘটনাগুলোর একটি সমষ্টি।’ এই যুক্তিতে, আমরা যা সময় বলে ভেবে থাকি-অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ-তা কেবল ঘটনাগুলোর ক্রমকে সম্পর্কের ভিত্তিতে সাজানোর পদ্ধতি।
আপনার মতামত জানানঃ