করোনা মহামারিতে সবচেয়ে বড় বিপর্যয়টা এসেছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। বলা চলে, করোনা বিশ্ব অর্থনীতির গতিকে শিথিল অবস্থায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। মহামারির ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে অর্থনীতি যতটা হেঁটেছে সেটাকে আদতে হাঁটাও বলা চলে না। তবে ইদানিং বিশ্ব অর্থনীতি কিছুটা গতি পেলেও স্বাভাবিক অবস্থায় এখনো ফিরেনি। তবে বিশ্বের সমস্ত দেশের অর্থনীতির আড়ালে করোনা মহামারির মাঝেও গতিতে চাঙ্গা হয়ে ফিরেছে চীনের অর্থনীতি। বলা চলে, অর্থনীতির ঘোড়-দৌড়ে চীন অনেক এগিয়ে এসেছে। বিভিন্ন গবেষণা আমেরিকার অর্থনীতিকে পেছনে ফেলতে চীনের দশ বছর সময় বেঁধে দিলেও চীন পাঁচ বছরেই কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এক বছর আগেও মনে করা হচ্ছিল যে অর্থনীতির আকারের দিক থেকে চীন ২০৩০এর দশকের প্রথম দিকে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িযে যাবে। কিন্তু গবেষণা বলছে, এ দশক শেষ হবার আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ হয়ে উঠবে চীন।
সেন্টার ফর ইকনোমিক্স এ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর) নামে যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি বলছে, করোনাভাইরাস মহামারি এবং তার অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া চীনের অনুকুলে কাজ করেছে। গতকাল চীনের জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরো (এনবিএস) জানায়, গত বছরের চতুর্থ প্রান্তিকে চীনের জিডিপি বছরওয়ারি বেড়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। তৃতীয় প্রান্তিকে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল চীন। গত প্রান্তিকের জন্য রয়টার্স ও ব্লুমবার্গের জিডিপি প্রবৃদ্ধি পূর্বাভাস ছিল যথাক্রমে ৬ দশমিক ১ শতাংশ ও ৬ দশমিক ২ শতাংশ।
প্রধান অর্থনীতিগুলোর মধ্যে একমাত্র চীনই গত বছর সংকোচন এড়াল। চলতি বছরেও এ ধারা অব্যাহত রাখবে বলে আশা করছে চীন। রয়টার্সের এক জরিপে চলতি বছরের জন্য চীনের প্রবৃদ্ধি পূর্বাভাস ৮ দশমিক ৪ শতাংশ।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি এ বছর ৫ শতাংশ সংকুচিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাই চীনের সাথে তার বৃহত্তম প্রতিদ্বন্দ্বীর ব্যবধান কমে আসবে বলে বিভিন্ন গবেষণায় ধারণা করা হচ্ছে। এ কারণে ডলারের হিসেবে চীনের অর্থনীতির মূল্যমান যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবার ঘটনাটি ঘটে যাবে আগে যা হিসেব করা হয়েছিল তার পাঁচ বছর আগেই। এ পূর্বাভাসের বড় খবরটি হলো চীনের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি ঘটছে দ্রুতগতিতে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৫ সালে তাদের বর্তমান পাঁচসালা পরিকল্পনার মধ্যেই তারা একটি উচ্চ-আয়ের অর্থনীতিতে পরিণত হবে এবং এক বছর আগেও যা মনে করা হয়েছিল তার পাঁচ বছর আগেই তারা যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে।
করোনা মহামারীর সূতিকাগার হলেও সবার আগে ঘুরে দাঁড়ানোয় বিশ্বে চমক সৃষ্টি করেছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিটি। শুরুতেই কঠিন লকডাউন কার্যকর, অন্যান্য দেশের তুলনায় সফলতার সঙ্গে সংক্রমণ ঠেকানো এবং কার্যকর সরকারি প্রণোদনায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে চীনের অর্থনীতি। করোনায় ধুঁকতে থাকা দেশগুলোয় চিকিৎসা যন্ত্রপাতি, ঘরে বসে কাজ করার সামগ্রী রফতানিও এতে বিশাল ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া অভ্যন্তরীণ বাজার চাঙ্গায় ভোক্তাদের হাতে সরকারি সহায়তা পৌঁছায় চীনের ভোক্তা খাত শক্তিশালী ছিল। গত বছরের প্রথম প্রান্তিকে করোনার চূড়ান্ত সময়ে দেশটির অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছিল ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। বছরের দ্বিতীয়ার্ধে ঘুরে দাঁড়ালেও বার্ষিক যে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, তা ১৯৭৬ সালের পর সর্বনিম্ন। ১৯৬৬ সালে শুরু হওয়া মাও জে দংয়ের সাংস্কৃতিক বিপ্লবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল চীনের অর্থনীতি। ১৯৭৬ সালে দেশটির অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছিল ১ দশমিক ৬ শতাংশ। তারপর দেন শিওপিংয়ের নেতৃত্বে ব্যাপক অর্থনৈতিক সংস্কার আনা হয় চীনে। এতে এশিয়ার প্রভাবশালী অর্থনীতি হওয়ার পথে এগিয়ে যায় দেশটি।
কেবল করোনাভাইরাস মোকাবেলাই নয়, শিল্পায়ন নিয়ে আগ্রাসী নীতির কারণেও চীনের অর্থনীতি ব্যাপক উপকৃত হয়েছে বলে মনে করছেন গবেষকরা। ব্রেক্সিট পরবর্তী যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি ২০২১ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত বছরে ৪ শতাংশ এবং ২০২৬ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত ১ দশমিক ৮ শতাংশ হারে বাড়তে পারে বলে ধারণা দেওয়া হয়েছে।
ভারত ২০১৯ সালে যুক্তরাজ্যকে টপকে পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হলেও কোভিড-১৯ মহামারী তাদেরকে ফের যুক্তরাজ্যের নিচে নামিয়ে এনেছে। দেশটি ২০২৪ সালের আগে যুক্তরাজ্যকে টপকাতে পারছে না বলেই অনুমান গবেষকদের। তবে এরপর থেকে ভারতের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে; ২০২৭ সালের মধ্যে তারা জার্মানিকে টপকাবে আর ২০৩০ সালে তারা জাপানকে টপকে তৃতীয় স্থানে উঠে আসবে বলে গবেষকদের পূর্বাভাস।
বিশ্বব্যাংক বলছে, চীনের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি যদিও চার দশকের সর্বনিম্ন, তবে বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে সংকোচনের মানে দাঁড়াচ্ছে, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে চীনের শেয়ার বাড়বে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পূর্বাভাস, ২০২৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রকে হটিয়ে বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতি হবে চীন। পূর্বের পূর্বাভাসের চেয়ে পাঁচ বছর আগেই এ জায়গায় পৌঁছবে এশিয়ার শীর্ষ অর্থনীতিটি। এছাড়া চলতি দশকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কার্যক্রমে চীনের অবদান থাকবে এক-চতুর্থাংশ।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চীন প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে অর্থনীতির চাকায় গতি বাড়িয়ে শীঘ্রই বিশ্ব অর্থনীতির হাল ধরতে যাচ্ছে। করোনা পরবর্তী পুঁজিবাদী বিশ্বের নিকট চীন ছাড়া বিকল্প কেউ নেই, এমনই অবস্থা অপেক্ষা করছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। চীনের অর্থনীতির ওপর ভর করে বিশ্ব অর্থনীতি চলার প্রায়াস খুঁজতে যাচ্ছেন বলে মনে করেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০০৫
আপনার মতামত জানানঃ